স্পটলাইট

আজ থেকে সুপার শপে পলিথিন নিষিদ্ধ, বিকল্প নিয়ে সংশয়ে ক্রেতারা

ঢাকা জার্নাল ডেস্ক:

• আজ থেকে সুপার শপে থাকবে না পলিথিনের ব্যাগ
• পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে যেতে হবে বাসা থেকে
• সুপার শপে ক্রেতাদের জন্য থাকবে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ
• পাটের ব্যাগের দাম পড়বে ৬ থেকে ১৭ টাকা

‘সুপার শপে মাছ-মাংস কীভাবে নেবো? এগুলো তো আর কাগজের ব্যাগে নেওয়া যায় না। নিরুপায় হয়ে পলিথিনে নিতে হয়। সেটার বিকল্প কী?’

সুপার শপের নিয়মিত ক্রেতা জহিরুল হক ঢাকা জার্নালকে বলছিলেন এভাবে।

সুপার শপে প্রায়ই কেনাকাটা করেন রাজধানীর মগবাজারের বাসিন্দা সালেহ আহমেদ। তিনি ঢাকা জার্নালকে বলেন, ‘পলিথিন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু তার যথাযথ বিকল্প সরকারকে ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানে চাল, ডাল, চিনি এরকম প্রতিটি পণ্যের জন্য একটা করে পলিথিন দরকার হয়, সেখানে হঠাৎ করে এতো ব্যাগ থাকবে কি না সেটা একটা বিষয়। ব্যাগের দাম বেশি পড়বে, সেটাও ক্রেতাকে দিতে হবে। আবার ব্যাগ কতদিন টেকসই হবে, এসব বিষয়ও আছে।’

এদিকে, বিভিন্ন সুপার থেকে ক্রেতাদের মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হচ্ছে। এতে বলা হচ্ছে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, ১লা অক্টোবর থেকে কেনাকাটা করতে নিজের পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

সুপার শপে থাকবে পাটের ব্যাগ

সুপার শপ ‘স্বপ্ন’র মালিবাগ আউটলেটের ম্যানেজার হাফিজ হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের শপের বিভিন্ন জায়গায় এরইমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমাদের যে টিস্যু ব্যাগ, জালি ব্যাগ ছিল সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। যার মূল্য ৬ টাকা থেকে ১৭ টাকা পর্যন্ত। ভোক্তাদের সেগুলো কিনে মালামাল নিতে হবে।’

‘আগোরা’র মগবাজার শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটলেট ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা আগেও কখনো পলিথিনের ব্যবহার করিনি। এতদিন টিস্যু ব্যাগ (নন-ওভেন) ও কাগজের ব্যাগ ছিল, সেগুলোও আজ থেকে বন্ধ। আজ থেকে পাটের ব্যাগের ব্যবস্থা রয়েছে, অন্যথায় কাস্টমাররা নিজ দায়িত্বে ব্যাগ নিয়ে আসবেন।’

তদারকি করতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তরকে

বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান ঢাকা জার্নালকে বলেন, ‘সুপার শপ স্টোরগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যাগ আছে কি না এটা পরিবেশ অধিদপ্তরকে তদারকি করতে হবে। ব্যাগের দাম কম নাকি বেশি সেটাও দেখতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণদের মনিটরিংয়ে রাখা যায়। ব্যাগ ব্যবহার মানুষের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। যারা বাজারে পাটের ব্যাগ তৈরি করবে, তাদের প্রথম দিকে ট্যাক্সমুক্ত করতে হবে। আবার যারা এখনো পলিথিন ব্যবহার করবে, তাদেরকে পলিউশন ট্যাক্স দেওয়া উচিত। শপগুলোতে পাটের ব্যাগ রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে, তাহলে মানুষও কিনতে বাধ্য হবে।’

সুপার শপে থাকবে না পলি ব্যাগ

এদিকে আজ ১ অক্টোবর থেকে দেশের সুপার শপগুলোতে নিষিদ্ধ হচ্ছে পলি ব্যাগের ব্যবহার। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে ক্রেতাদের জন্য পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, পাট মন্ত্রণালয় সব সুপার শপের সঙ্গে সভা করে পাটের শপিং ব্যাগের সরবরাহ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ধীরে ধীরে ১ নভেম্বর থেকে সব কাঁচাবাজারেও পলিথিন ব্যবহার বন্ধে এ পদক্ষেপ কার্যকর হবে। একই সঙ্গে ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানো হবে।

পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে তিন ধাপের পরিকল্পনা

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হলে উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজারে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার বন্ধের পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ‘ক্লিন-আপ’ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সেখানে বিকল্প সামগ্রীও বিতরণ করেন তিনি। এসময় পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে তিন ধাপের পরিকল্পনা তুলে ধরেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, প্রথম ধাপে ১ অক্টোবর থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক সুপারশপগুলোয় এই ব্যাগ বন্ধ করা হচ্ছে। তবে এটি সরকারের একক সিদ্ধান্ত নয়। দ্বিতীয় ধাপে ১ নভেম্বর থেকে কাঁচাবাজারগুলোতে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানায় অভিযান চলবে। তখন আইনের প্রয়োগও হবে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রিসাইকেল হলো শেষ ধাপ, যখন আর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে রিসাইকেল হচ্ছে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। কেমিক্যাল ম্যানেজমেন্ট করে রিসাইকেল হচ্ছে না। তাপ দিয়ে গলিয়ে আবার নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে। এটিকে রিসাইকেল শিল্প বলা যায় না।

এখনই সব ধরনের প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না জানিয়ে উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘পলিথিন ব্যবহার বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। কারণ সতর্ক করা এবং কঠোর হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। তবে শাস্তি দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ক্ষতিকর এই ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তবে ভোক্তা পর্যায়েও সচেতনতা দরকার।’

পলিথিনের বিকল্প নতুন করে আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, পলিথিনের বিকল্প প্রথাগতভাবেই আছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও আরও ২০টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে যারা বিকল্প নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া সুপার শপ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে ব্যাগের সংখ্যার তালিকা দেওয়া হয়েছে এবং যোগানের ব্যবস্থাও হয়েছে। তাই বিকল্প নেই এ তর্কের সুযোগ নেই, চাহিদা থাকলে সরবরাহও আসবে।

আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ হলেই মানুষ ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাবে

পলিথিনের ব্যবহার নিয়ে এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) মহাসচিব ড. শাহরিয়ার হোসেন ঢাকা জার্নালকে বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন করার ২২ বছর হলো তবু বাজারে পলিথিন বন্ধ করতে পারেনি প্রশাসন। ২০০২ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত আইনের প্রয়োগ ছিল। তাহলে এত বছর কেন পলিথিনের বিকল্প বাজারে এলো না? আইন প্রয়োগ করতে ২২ বছর লাগলো কেন? রুয়ান্ডা, কেনিয়াতেও আইন প্রয়োগ হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ প্রথম দেশ, যে পলিথিন নিষিদ্ধ করে। মূলত প্রশাসনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল না, যার ফলে আইন প্রয়োগ হয়নি।

‘এখন অন্তর্বর্তী সরকার এসে ধাপে ধাপে আইনটি প্রয়োগ করছে। সুপার শপগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই এমন করা হয়েছে। সুপার শপ ও বাজার মালিক সমিতি ১ মাস করে সময় চেয়েছে। তাই বিকল্প নেই, এটা বলা উচিত হবে না। বাস্তবতা হলো, যেটা ২২ বছর ধরে করা হয়নি, সেটা এখন করতে কিছুটা কষ্ট হবে। সে ক্ষেত্রে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ হলেই মানুষ ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাবে।’

মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে জানিয়ে ড. শাহরিয়ার বলেন, ‘মানুষ অভ্যাসের দাস, তাদের সাময়িক অসুবিধা হতে পারে। সুপার শপ থেকে যারা কেনাকাটা করেন তাদের ব্যাগ কেনার সামর্থ্য রয়েছে। খোলা বাজারে ব্যাগের দাম নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তবে আমরা চেষ্টা করছি ক্রেতার নাগালের মধ্যে রাখার জন্য। আশা করি ব্যাগ ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে।’

পর্যাপ্ত ব্যাগ মজুত আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার হোসেন ঢাকা জার্নালকে বলেন, অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ব্যাগের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাগ তৈরি করবে। হয়তো প্রথম দিকে সংকট দেখা দেবে। কিন্তু ক্রেতারা পাটের ব্যাগ কিনলে সেটা অনেকদিন ব্যবহার করতে পারবেন। ১ থেকে ১০ টাকার ব্যাগ ২/৩ মাস ব্যবহার করা যায়। ফলে মানুষের মাঝে পুনরায় ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে।