যে কারণে বাড়তি চালের দাম
অনেকদিন ধরেই চালের বাড়তি দামে ভুগছে সাধারণ মানুষ। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আশ্বাস দিয়েছিল আমন উঠলে চালের দাম কমবে। এখন আমনের ভরা মৌসুম চলছে, নতুন ধানের চাল পুরোদমে বাজারে আসছে। কিন্তু দাম কমেনি, বরং বেড়েছে।
বাংলাদেশে আমনের মৌসুমকে চালের সুবর্ণ সময় বিবেচনা করা হয়। সেই মৌসুমে্ কেন এত দাম তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। এখন পর্যন্ত সরকারের বক্তব্য গতানুগতিক। যেমন চালের দাম বাড়ার পেছনে সাময়িক মজুদদারিকে দায়ী করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি এটাও দাবী করেছেন চালের কোন ঘাটতি নেই। মজুদদারি যদি থেকেই থাকে তাহলে তা থেকে বাজারকে মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারের।
আসল কথা হলো চাল আমদানি কম হয়েছে এবং স্থানীয় উৎপাদন থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে আমন মৌসুমে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়নি। সরকারি গুদামের মজুত কম থাকায় বাজারে চালের সরবরাহ কমেছে এবং দাম বেড়ে গেছে। সাধারণত আমন মৌসুমে চালের সরবরাহ ভালো থাকে এবং দামও কম থাকে। ফলে সরকার এখন মজুত বাড়াতে আমদানির ওপর জোর দিচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ওএমএস এবং টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
বুধবার প্রকাশিত সরকারি এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক মাসে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। মোটা চাল প্রতি কেজিতে ৩-৪ টাকা বেড়ে এখন ৫৪-৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ডিসেম্বরের শেষে ছিল ৫০-৫৫ টাকা। মাঝারি এবং মিহি চালের দামও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
চালের এই বাড়তি দামের কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দ্রুত চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চালের আমদানি বাড়লেও কমছে না দাম। এক মাসের ব্যবধানে গত ডিসেম্বরে ৬৪৫ শতাংশ বেড়েছে চালের আমদানি। আর বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩১ হাজার ৩২৬ শতাংশ। তবে আমদানির লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। গত ১ জুলাই থেকে ২ জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ১৭ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তর থেকে গত অক্টোবরে ১০ লাখ টন চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তার কথা সরকারকে জানানো হয়েছিল। সর্বশেষ সরকারি তরফে জানানো হয়েছে যে, ভারত থেকে ৫০ হাজার টন নন-বাসমতী সেদ্ধ চাল আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, মজুদদারির কারণে দাম বাড়ছে। তবে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, একটা বড় কারণ চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। সরকারি ভাষ্যমতে সম্প্রতি বিভিন্ন কারণে চালের উৎপাদন খরচ বেশ বেড়ে গেছে। বাড়তি পরিবহন খরচ, কৃষি শ্রমিকের মজুরি, কৃষি যন্ত্রপাতি, সার ও কীটনাশকের দাম প্রভাব রেখেছে উৎপাদন খরচে। আরও বেড়েছে ক্ষেতে পানি সরবরাহ দেওয়ার ডিজেল-কেরোসিন ও বিদ্যুতের দাম। তাছাড়া সার্বিকভাবে যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তার প্রভাবও আছে। কারণ কৃষককে ধান বা চাল বিক্রি করেই সারা বছর জীবন চালাতে হয়।
আরেকটি কারণ হাট বাজারে চাঁদাবাজি। ক্ষমতার হাতবদলের পরে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে চাঁদাবাজরা, যার প্রভাব পড়ছে বাজারগুলোতে। চাল আমদানি পরিস্থিতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারা এবং সরকারের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায়ও বেড়েছে চালের দাম।
দেশের চালের দাম চালকল মালিক তথা চাল ব্যবসায়ীদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। মূলত চালকল মালিকরা কীভাবে চালের বাজার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন সেটা বুঝতে পারাই মনে হয় বড় কাজ দেবে দাম কমানোতে। বরাবরই চালকল মালিক ও বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে বাড়তি দামে ধান কিনতে থাকে। এতে চালের দাম বাড়তে থাকে। প্রতিযোগিতা করে ধান কেনার এই পদ্ধতি কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সেই পথ দেখতে হবে সরকারকে।
আরেকটি কারণ হলো চালকল মালিকরা বিপুল পরিমাণে কেনা ধান চালে রূপান্তর করেন এবং নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার মাধ্যমে অপর্যাপ্ত পরিমাণে চাল বাজারে ছেড়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এর মাধ্যমে তারা বেশি লাভ করেন। এটাই সিন্ডিকেশন বা কারসাজি। নজরটা এখানেই দিতে হবে সরকারকে।