পাকস্থলীর স্বাস্থ্য যেভাবে মনে প্রভাব ফেলে
মানুষের কোলেস্টেরলের মাত্রা থেকে শুরু করে মানসিক রোগসহ যাবতীয় সবকিছুর সঙ্গে অন্ত্র বা পেটের স্বাস্থ্যের সংযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে গবেষণা থেকে। সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর পেটের স্বাস্থ্যের প্রভাব নিয়ে যেমন জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে, একইভাবে পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখা নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে।
পোলারিস মার্কেট রিসার্চের তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রোবায়োটিকের বাজার ২০২১ সালে প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। আর ২০৩০ সাল নাগাদ পর্যন্ত প্রতি বছর এই হার সাত শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পেটের স্বাস্থ্য কেন ভালো রাখা গুরুত্বপূর্ণ এবং কীভাবে এই স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারেন? সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা। এবার তাহলে এ ব্যাপারে জেনে নেয়া যাক।
সুস্থ পাকস্থলী কী: মানবদেহের অন্ত্র বা পাকস্থলী থেকে পায়ু পর্যন্ত দীর্ঘ প্যাঁচানো যে নালি থাকে, তার গঠন খুবই জটিল। এ কারণে পাকস্থলীর সুস্থতা শনাক্ত করা অন্যান্য অঙ্গের সুস্থতা শনাক্ত করার মতো এতটা সহজ নয়। আবার পাকস্থলীর স্বাস্থ্য পরিমাপের জন্য কোনো একক উপায় নেই, যা ব্যবহার করা যায়। মানবদেহের পাকস্থলী জীবাণুতে ভরা। জীবাণুর সংখ্যা এতই বেশি যে, সব জীবাণুকে যদি একত্রিত করা হয় তাহলে তাদের ওজন এক কেজি ৮০০ গ্রামেরও অধিক হবে।
পাকস্থলীতে পিত্ত, শ্লেষ্মা, রকমারি অণুজীব, হজম হওয়া খাবার, অপাচ্য বা শোষিত খাবার ও বিপাকীয় খাবারসহ বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে। এসব উপাদানের প্রতি গ্রামে ব্যাকটেরিয়া রয়েছে ১০ হাজার কোটি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. ক্যাটেরিনা জনসন পাকস্থলী ও মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেছেন। বলেছেন, একটি সুস্থ পাকস্থলীতে বৈচিত্র্যময় জীবাণু থাকে। এখনো মাইক্রোবায়োম বিজ্ঞান তুলনামূলকভাবে একটি অপরিণত গবেষণা ক্ষেত্র। অর্থাৎ, এখনো বিশদভাবে আমরা জানি না যে, একটি সুস্থ পাকস্থলী কেমন হয়ে থাকে দেখতে।
ডা. ক্যাটেরিনা জনসন বলেন, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আমাদের মাইক্রোবায়োমগুলো এতই স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যময় যে, এর মধ্যে মাইক্রোবায়োমগুলোর হাজার হাজার প্রজাতি রয়েছে (প্রজাতির মধ্যে রকমারি স্ট্রোন রয়েছে)। এর মধ্যে আবার অনেকগুলোর কার্যকারিতা সম্পর্কে অজানা।
কেন পাকস্থলী সুস্থ থাকা প্রয়োজন: ডা. ক্যাটেরিনা জনসন বলেন, পাকস্থলী হচ্ছে এমন গুরুত্বপূর্ণ, যা শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে প্রভাবিত করতে পারে। পাকস্থলী ও মস্তিষ্কের মধ্যে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। যা গা গাট ব্রেইন এক্সিস (পাকস্থলী-মস্তিষ্কের অক্ষ) নামে পরিচিত। এখানে পাকস্থলী ও মস্তিষ্ক একে অপরের জন্য অপরিহার্য। গবেষণায় দেখা গেছে, পাকস্থলীর মাইক্রোবায়ামের অনুপস্থিতির জন্য মস্তিষ্কের বিকাশ স্বাভাবিক হতে পারে।
এছাড়া কখনো কখনো পাকস্থলীকে দ্বিতীয় মস্তিষ্ক বলা হয়। কেননা, পাকস্থলীতে ব্যাকটেরিয়া মস্তিস্কের ১০ কোটি নিউরনের মাধ্যমে মানুষের আচরণ প্রভাবিত করতে পারে। নিউরন হচ্ছে মস্তিষ্ক ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে থাকা কোষ, যা মানবদেহের শরীরকে বার্তা দিয়ে থাকে যে কখন কোন ধরনের আচরণ করতে হবে। মানুষের পাকস্থলী, মস্তিস্কে সেরোটোনিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটার তৈরি করতে পারে। যা মানুষের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
এদিকে নিউরোট্রান্সমিটার এক ধরনের বার্তাবাহক, যা স্নায়ুসন্ধির মাধ্যমে এক নিউরন থেকে অপর নিউরনে রাসায়নিক সিগন্যাল পাঠিয়ে থাকে। মানুষের পাকস্থলীর সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে খাদ্য থেকে পুষ্টি শোষণ করা। এ ব্যাপারে ভারতের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট ডা. ভেঙ্কটরামন কৃষ্ণ এক ব্যাখ্যায় জানান, মানুষ তার মলের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয় পানি ও খনিজ পদার্থ হারাতে পারেন না।
যুক্তরাজ্যের দ্য গাট হেলথ ডক্টর নামে পরিচিত মেগান রসি বলেছেন, পাকস্থলীতে জীবাণুর ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে ৭০টিরও বেশি বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। এসবের মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ ও শ্বাসযন্ত্রজনিত সমস্যা। একইসঙ্গে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো অটোইমিউন রোগ হওয়ারও ঝুঁকি থাকে।
ডা. রসি বলেছেন, মানবদেহ রোগ প্রতিরোধ করার ইমিউন কোষগুলোর প্রায় ৭০ শতাংশ পাকস্থলীতে বাস করে। এই কোষগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত থাকে। ফলে যাদের পাকস্থলীর স্বাস্থ্য ভালো, তাদের রোগ প্রতিরোধ সিস্টেম স্বাভাবিক থাকে বলে মনে করা হয়।
কীভাবে পাকস্থলীর স্বাস্থ্য ভালো করতে পারেন: ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাট প্রজেক্ট পরিচালিত এক গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা পাকস্থলীতে মাইক্রোবায়োমের বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৩০টি ভিন্ন ভিন্ন উদ্ভিজ্জ খাবার খাওয়ার কথা জানান। এর মধ্যে ফল ও সবজি ছাড়াও বীজ, মশলা ও বাদাম খাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে ডা. রসি পরামর্শ দিয়েছেন, খাদ্যতালিকায় ছোট ছোট পরিবর্তন এবং বাজার থেকে রকমারি ফল কিনলে এই বৈচিত্র্য আনা সহজেই সম্ভব। যেমন, সকালের নাশতায় শস্যের তৈরি খাবার খেলে তাতে শুধু ওটস না দিয়ে বাটির অর্ধেক ওটস ও বাকি অর্ধেক রান্না করা কুইনোয়া খাওয়া যেতে পারে। এর উপর রকমারি ফলের টুকরো ও বীজও দিতে পারেন। আবার সপ্তাহে যদি একবার মাংসের ডিশ খাওয়া হয়, তাহলে এতে কিছুটা মাংসের পরিবর্তে ফাইবার সমৃদ্ধ মসুর ডাল মেশানো যেতে পারে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস অনুযায়ী, ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি দিয়ে থাকে। আবার ফাইবার হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা প্রতিরোধ করে। এ জন্য যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতিদিন অন্তত ৩০ গ্রাম পরিমাণ ফাইবার গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকে।
ফাইবার গ্রহণের ক্ষেত্রে সাদা রুটির পরিবর্তে হোল গ্রেইনের বাদামি রুটি বা দানাদার রুটি খেতে পারেন। সঙ্গে বাদামি চাল বা আস্ত গমের পাস্তা নিলে ফাইবারের পরিমাণ বেশি পাওয়া যাবে। ফাইবারের অন্যান্য উৎসের মধ্যে আলু বা সিদ্ধ আলু, ডালজাতীয় খাবারের মধ্যে মটরশুঁটি, মসুর ডাল, ছোলা খেতে পারেন। নির্দিষ্ট ধরনের ফাইবার ও কার্বোহাইড্রেট পাকস্থলীতে ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে কলা, পেঁয়াজ ও পেঁয়াজ পাতা, রসুন, বাঁধাকপি, ওটস, ব্লুবেরি ও আঙুর খেতে পারেন।
আবার একটানা না খেয়ে থাকা (ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং) বা রাতের খাবার ও সকালের খাবারের মধ্যে অন্তত ১২ ঘণ্টা বিরতি বজায় রাখতে পারলে পাকস্থলীর জীবাণুর উপকার হতে পারে। লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক টিম স্পেক্টর তার 'স্পুন-ফেড' বইতে এ ব্যাপারে লিখেছেন, খাবার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার অধিকাংশই কেন ভুল।
পাকস্থলীর স্বাস্থ্যের জন্য কোন খাবারগুলো ক্ষতিকর: পাকস্থলীর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার, অ্যালকোহল ও তামাকজাত দ্রব্য-পণ্য ভালো নয় বলে জানিয়েছেন ডা. কৃষ্ণ। তিনি বলেন, অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবারে এমন উপাদান থাকে, যা পাকস্থলীর ভালো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি নষ্ট করে দেয় বা খারাপ ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি করে থাকে।
বসবাস অঞ্চলের ওপর নির্ভর করে রাস্তার পাশে থাকা খাবার কতটা এড়িয়ে যেতে হবে আপনাকে। আপনার অঞ্চল বা শহরের রাস্তার পাশের খাবার যদি অস্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি হয়, তাহলে তা এড়িয়ে যেতে হবে। রাস্তা থেকে ফল-মূল ও শাকসবজি কিনলে তা খাওয়ার আগে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
আবার মানসিক চাপও পাকস্থলীকে প্রভাবিত করে থাকে। এ চাপ থেকে অ্যাসিড রিফ্লাক্স, অর্থাৎ গ্যাস ও আলসারেশন বা পেটে জ্বালাপোড়ার সমস্যা হতে পারে। ডা. জনসন বলেছেন, যারা প্রচুর মানসিক চাপে থাকেন তাদের পাকস্থলীতে বৈচিত্র্যময় মাইক্রোয়াম কম পরিমাণে থাকে।
প্রোবায়োটিক এবং পাকস্থলীয়র স্বাস্থ্য পরীক্ষা কতটুকু কার্যকর: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রোবায়োটিক নির্দিষ্ট কারণে ব্যবহার করা হলে সেটি কাজ করতে পরে। ডা. মেগান রসি বলেছেন, প্রোবায়োটিক নির্দিষ্ট পরিমাণে নির্দিষ্ট সময় ধরে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে খেতে হবে। আপনি যে প্রোবায়োটিক পণ্য পাচ্ছেন সেটি আপনার পাকস্থলীর স্বাস্থ্য উন্নত করবে এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই বা নিশ্চিত করে বলা যায় না। বরং যেসব পাওয়া যায় তা প্রতিদিন গ্রহণেরও প্রয়োজন নেই। কিছু দেশ এ ধরনের পণ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রাহকদের পাকস্থলীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ জন্য তারা গ্রাহকদের মলের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা করে থাকে।
এ চিকিৎসক বলেন, এসব পরীক্ষায় যে প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ হয় বলে প্রচার করা হয়, মূলত সেভাবে কোনো লাভ হয় না। তবে ওই পরীক্ষার মাধ্যমে পাকস্থলীর জীবাণুর বৈচিত্র্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।