Leadঢাকাশীর্ষ সংবাদসংবাদ শিরোনাম

ব্যাংকিং কমিশন সময়ের দাবি, বিলুপ্ত করতে হবে অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

ছাত্র জনতার অভীষ্ট জয়লাভ। এমন গণঅভ্যুথ্যান আগে কখনও দেখা যায়নি। পুরো দেশের ওপর এখন আন্দোলনে বিজয়ীদের নিয়ন্ত্রণ। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশামত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড.মুহম্মদ ইউনুস। এখন মানুষের আশা যে তাঁর প্রতিশ্রুতিসমূহ নিশ্চয়ই বাস্তবায়িত হবে।

তাঁর ওপর মানুষের যে আশা বেশি তার নাম অর্থনীতির পুনরুত্থান। তার সামনে দু’টি পথ। প্রথম,মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে কিঞ্চিৎ স্বস্তি দেওয়া এবং দ্বিতীয়, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে যে সীমাহীন লুটপাট ও দুনীতি শাসন হয়েছে তা চিহ্নিত করে দোষীদের শাস্তি দেয়া। আর্থিক খাতের টেকসই সংস্কারের জন্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠন এখন সরকারের প্রধান এজেন্ডা। এ ছাড়া আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি ও সংস্কার বিষয়ে একটি রূপকল্প তৈরি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে।

গণমানুষের তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটেছে। কিন্তু তার আসলে এমনিতেই দিন ফুরিয়ে আসছিল এবং তার বড় কারণ ছিল বেসামাল দুর্নীতি। নিজের প্রশ্রয়ে একের পর এক ব্যাংক তিনি খেতে দিয়েছেন এক শ্রেণির লুটেরাদের। তার সরকার আর্থিক আগ্নেয়গিরির শিখরে বসে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে খামখেয়ালিভাবে দেশ চালিয়েছে। বুঝতেও পারেনি, যে কোনদিন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গিয়ে সরকারের পুরো আর্থিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে পারে। এবং সেটাই ঘটেছে।

গত জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের সময়ই বলা হচ্ছিল যে, দেশের আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে রক্তক্ষরণের কথা গণমাধ্যমে আসছিল বেশ নিয়মিতভাবেই। বারবার সরকারকে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছিল যে, খেলাপি ঋণ,জাল-জালিয়াতি, পারিবারিক আধিপত্য বৃদ্ধি এবং একটি একক গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে ব্যাংকিং খাত। সামগ্রিকভাবে যে সুশাসন নেই তা স্বীকার করার মানসিকতাও ছিল না সরকারের আচরণে।

ড. ইউনুসের সরকার এ অবস্থা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। আমরা এই ভাবনাকে স্বাগত জানাই। প্রথমে যা দরকার তা হলো ব্যাংকিং খাত নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা প্রয়োজন। কারণ এই খাতটিকে পরিকল্পিতভাবে লুটেরাদের হাতে তুলে দিয়েছিল বিগত সরকার। ফলে ব্যাংকিং খাতটি ক্রমে অদক্ষতা,অসাধুতা ও খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। একক ব্যক্তি এস আলমের হাতে সাতটি ব্যাংক তুলে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। এর মধ্যে অন্যতম ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ যেটি শুধু দেশের সবচাইতে বড় ব্যাংক-ই ছিল, ছিল এশিয়ার অন্যতম সুশাসিত ব্যাংক। সেই ব্যাংকটি এখন বেনামি ঋণ,তারল্য সংকটে জর্জরিত।

একটা সময় ছিল সরকারি ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি ছিল। শেখ হাসিনার আমলে এই ব্যাধি ছড়িয়ে দেয়া হয় ব্যক্তি খাতের ব্যাংক এবং লিজিং কোম্পানিগুলোতেও। আইন করে ব্যাংকের মালিকদের ও তাদের পরিবার বর্গের জমিদারি কায়েম করা হয়। এই সময়ে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেংকারি,বেসিক ব্যাংক লোপাট করা, ফার্মার্স ব্যাংক নাই করে দেয়া, জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট গ্রুপ কেলেংকারি, পি কে হালদারের পিপলস লিজিং কেলেংকারিসহ অসংখ্য ঘটনায় বাংলাদেশের ব্যাংকি খাতের ওপর মানুষের আস্থা একেবারে তলানীতে চলে যায়। কিন্তু সরকারি প্রশ্রয়ে লুটপাট ঠিকই চলছিল বাধাহীনভাবে।

এই বাস্তবতায় প্রস্তাবিত ব্যাংকিং কমিশন গঠন একেবারেই একটি জরুরি পদক্ষেপ। এটি গঠন করা এ কারণে প্রয়োজন যে,জাতির সামনে ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা নৈতিক দায়িত্ব। আর এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারব ব্যাংকিং খাতের জন্য সামনের দিনের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী। এই কমিশনের একটি বড় কাজ হবে ব্যাংকিং খাতের সমস্যার জন্য কারা এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান দায়ী তাদের চিহ্নিত করা। স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকটাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী ধরনের প্রশাসনিক, আইনগত ও কাঠামোগত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সে ব্যাপারে অর্থবহ ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা তৈরি করাও হবে কমিশনের বড় কাজ। সবার আগে যে কাজটা করা দরকার তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করার জন্য গঠিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি। এটি করা না গেলে কোন কাজই শেষ পর্যন্ত ফলদায়ক হবে না।

বিদ্যমান বাস্তবতায় এখন যদি এই স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠিত হয় ব্যাংক খাতটির ওপর জনগণের হারানো আস্থা ও বিশ্বাস কিছুটা ফিরে আসতে শুরু করবে। তবে কমিশন যা কিছু সুপারিশ করুক না কেন, তা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সক্ষমতা। দেশের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে ব্যাংক কমিশনের জন্য।