চীন-ভারত সম্পর্ক: পুনরারম্ভের এক নতুন যাত্রা

যখন বিংশ শতাব্দী এমন অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, তখন চীন-ভারত সম্পর্কের দিকনির্দেশনা কেবল এশিয়ার শান্তি ও সমৃদ্ধিকেই প্রভাবিত করে না, বরং বৈশ্বিক ভূদৃশ্যের বিবর্তনকেও আকার দেয়। বিশ্বের দুটি বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে, যাদের সম্মিলিত জনসংখ্যা ২৮০ কোটিরও বেশি এবং যাদের সম্মিলিত জিডিপি বিশ্ব অর্থনীতির ২০ শতাংশের বেশি, চীন-ভারত সম্পর্কের সুস্থ বিকাশ দুই দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সমাজের অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা।
২০২৪ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার কাজানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের আগস্টে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই'র ভারত সফরে অর্জিত বহুবিধ ঐকমত্য পর্যন্ত, চীন-ভারত সম্পর্ক এক নিম্নমুখী অবস্থা থেকে স্থিতিশীল পুনরুদ্ধারের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটময় সময়ে,সক্রিয় ও যৌথভাবে চীন-ভারত সম্পর্ক পুনরারম্ভের প্রচেষ্টা কেবল দৃঢ় বাস্তব ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো নয়, বরং এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী কৌশলগত গুরুত্ব।
ঘন ঘন উচ্চপর্যায়ের সংলাপ সম্পর্ক পুনরারম্ভে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বিনিময়ের হার ও গভীরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে,যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নে শক্তিশালী কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট শি ও প্রধানমন্ত্রী মোদির কাজান বৈঠককে দুই দেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত হিসেবে দেখেছে, যা চীন-ভারত সম্পর্ককে নানা সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সেই বৈঠকে শি জোর দিয়ে বলেন,চীন-ভারত সম্পর্ক মূলত নির্ভর করে এই প্রশ্নের ওপর -বিশাল জনসংখ্যা-সমৃদ্ধ দুটি প্রতিবেশী উন্নয়নশীল দেশ একে অপরকে কীভাবে দেখবে। বর্তমানে উন্নয়নই দুই দেশের সবচেয়ে বড় যৌথ লক্ষ্য। চীন ও ভারত একে অপরকে হুমকি নয়,বরং উন্নয়নের সুযোগ এবং সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। অন্যদিকে,মোদি উল্লেখ করেন,দুই প্রাচীন সভ্যতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে চীন-ভারতের সহযোগিতা বৈশ্বিক পুনরুদ্ধার ও বহুমেরুকরণে অবদান রাখবে।
এই বৈঠক চীন-ভারত সম্পর্ক পুনরারম্ভের জন্য কৌশলগত ভিত্তি স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বেইজিংয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কাজান বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উপায় ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে চুক্তি হয়।
২০২৫ সালের আগস্টে ওয়াং ই'র ভারত সফর তিন বছরেরও বেশি সময় পর প্রথম উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক সফর ছিল, যা সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ওয়াং ই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন,যেখানে সীমান্ত ও সহযোগিতার নানা বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো হয়।
মূল ঐকমত্য সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট পথ নির্ধারণ করছে উচ্চপর্যায়ের ঘন সংলাপের ধারাবাহিকতায় চীন ও ভারত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক,আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ইস্যুতে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
প্রেসিডেন্ট শি বারবার জোর দিয়ে বলেছেন,চীন-ভারতকে একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়,বরং অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে। মোদি একইভাবে বলেন,উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করার জন্য ভারত-চীনের যৌথ সহযোগিতা অপরিহার্য।
সীমান্ত ইস্যুতেও উভয় দেশ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধানের ওপর জোর দিয়েছে। ২৪তম বিশেষ প্রতিনিধি বৈঠকে ১০ দফা ঐকমত্য হয়,যার মধ্যে বিশেষজ্ঞ দল গঠনের মতো নতুন ব্যবস্থা সীমান্ত সমস্যা সমাধানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী তিনটি সীমান্ত বাজার পুনরায় খোলার সিদ্ধান্ত সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে সহায়ক হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে,দুই দেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপে সম্মত হয়েছে। ভারতের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের সুপারিশ করেছে,যা ভারতের শিল্পোন্নয়ন ও বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে অন্তর্ভুক্তিতে সহায়তা করবে।
মানুষে-মানুষে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০২৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭৫ বছর পূর্তি যৌথভাবে উদযাপন,সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালু,সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের বিনিময়সহ নানা উদ্যোগের মাধ্যমে পারস্পরিক বিশ্বাস জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের জন্য চীনের শৃঙ্গ ও হ্রদ সফরও পুনরায় শুরু হচ্ছে।
অনুকূল পরিস্থিতির সঞ্চয় সম্পর্ক উন্নয়নে মজবুত ভিত্তি তৈরি করছে চীন-ভারত সম্পর্ক পুনরারম্ভ কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়;বরং এটি এক অবশ্যম্ভাবী প্রবণতা,যা যৌথ স্বার্থ,বাস্তব চাহিদা ও ঐতিহাসিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
অর্থনৈতিক পরিপূরকতা উভয় দেশের সহযোগিতার ভৌত ভিত্তি গড়ে তুলেছে। চীনের উৎপাদনশীলতা ও পরিকাঠামো এবং ভারতের বাজার ও শ্রমশক্তি একে অপরকে পূর্ণতা দেয়। ২০২৪ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩৮.৪৮ বিলিয়ন ডলার,এবং ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে তা ৭৪.৩ বিলিয়নে পৌঁছে ১০.২% বৃদ্ধি পায়।
মানুষে-মানুষে সম্পর্কও পুনর্জাগরিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে চীন ভারতীয় নাগরিকদের ৭০,০০০ ভিসা দিয়েছে,যা আগের বছরের তুলনায় ১৫% বেশি। সরাসরি ফ্লাইট ও ভিসা সহজীকরণের ফলে এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।
এছাড়া, এসসিও, ব্রিকস ও জি২০-এর মতো বহুপাক্ষিক কাঠামো দুই দেশের সহযোগিতাকে আরও দৃঢ় করছে। বিশ্বে একমেরুকরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় চীন-ভারত একসঙ্গে বহুমেরুকরণকে এগিয়ে নিচ্ছে।
ইতিহাসের অবশ্যম্ভাবী প্রবণতা ২০২৪ সালের কাজান বৈঠকের কৌশলগত দিকনির্দেশনা থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের ওয়াং ই'র সফরে অর্জিত বাস্তব সাফল্য পর্যন্ত,চীন-ভারত সম্পর্ক ধীরে ধীরে সুস্থ ও স্থিতিশীল ধারায় ফিরে আসছে।
যদিও পথ সহজ হবে না এবং আস্থার ঘাটতি রাতারাতি দূর হবে না,তবুও যদি উভয় দেশ দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্পর্ককে দেখে,পার্থক্য সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করে,যৌথ স্বার্থে সহযোগিতা বাড়ায় এবং একে অপরকে হুমকি নয় বরং সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে,তবে সম্পর্কের অচলাবস্থা ভেঙে একটি নতুন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ গড়ে তোলা সম্ভব।
সম্প্রতি তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত এসসিও সম্মেলন চীন-ভারত সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে। আশা করা যায়,দুই দেশ এই গতি কাজে লাগিয়ে সম্পর্ককে আরও স্থিতিশীল,পরিণত,প্রাণবন্ত ও স্থায়িত্বশীল করবে এবং বহুমেরুকৃত বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতান্ত্রিকীকরণে যুগোপযোগী অবদান রাখবে।
চীনের গ্লোবাল টাইমস পত্রিকা থেকে অনুদিত।
Comments