প্রাইজবন্ডে আস্থা হারাচ্ছেন মানুষ

একসময় বিয়ের উপহার হোক বা জন্মদিনের শুভেচ্ছা, প্রাইজবন্ড ছিল এক প্রিয় চয়ন। ১০০ টাকার বিনিময়ে লাখ টাকার পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই দিন এখন অনেকটাই অতীত। দিনে দিনে প্রাইজবন্ডের প্রতি মানুষের আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ আর আলমারিতে তুলে রাখছেন না 'ভাগ্যের কাগজ'। বরং যারা আগেই কিনে রেখেছিলেন, তারাও ধীরে ধীরে ভাঙিয়ে ফেলছেন। মূল কারণ স্বচ্ছতার অভাব, সিন্ডিকেটের গুঞ্জন ও বড় অঙ্কে ভাঙাতে গিয়ে হয়রানির আশঙ্কা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে প্রাইজবন্ড বিক্রি হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার, সেখানে ২০২৩-২৪ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ৬৫০ কোটি টাকায়। প্রায় অর্ধেক কমেছে বিক্রি।
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. সবুর হাসান বলেন, 'সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে প্রণোদনা তো নেই-ই, তার উপর যদি স্বচ্ছতা না থাকে, তাহলে সাধারণ মানুষ অবশ্যই মুখ ফিরিয়ে নেবে। সেটাই এখন ঘটছে।'
প্রাইজবন্ডের ড্র হয় প্রতি তিন মাসে। একটি ১০০ টাকার বন্ডেই রয়েছে ৬ লাখ টাকার প্রথম পুরস্কার। আরও রয়েছে চারটি ক্যাটাগরিতে মোট ৩ হাজার ৭৭২টি পুরস্কার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই পুরস্কারগুলো যাচ্ছে কার কাছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেয়া হয় কেবল সিরিয়াল নম্বর, নাম নয়। কোথাও পাওয়া যায় না পূর্ণাঙ্গ তালিকা। এতে তৈরি হয় প্রশ্ন, পুরস্কার কি গোপনে ভাগ হয়ে যাচ্ছে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে?
উত্তর বাড্ডার ওষুধ ব্যবসায়ী সঞ্জয় দাস বলেন, 'প্রতিবারই দেখি পরিচিত কারও ভাগ্যে কিছু জোটে না। অথচ কিছু নির্দিষ্ট নম্বরের সিরিজ বারবার জয়ী হয়। সন্দেহ তো হবেই।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'ড্র প্রক্রিয়া যেহেতু অস্বচ্ছ, সেখানে সিন্ডিকেটের সুযোগও থেকেই যায়। অনেক সময় পুরস্কার নিতেও হয়রানির মুখে পড়েন গ্রাহকরা।'
যারা বড় অঙ্কে বন্ড ভাঙাতে চান, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। পাঁচ লাখ টাকার বেশি ভাঙাতে চাইলে চাওয়া হয় অর্থের উৎস। এমনও অভিযোগ আছে, দু'সপ্তাহ ধরে ঘোরানোর পরেও টাকা পাননি একজন গ্রাহক।
প্রাইজবন্ডের চেয়ে এখন বেশি জনপ্রিয় 'মোবাইল ব্যাং', 'ডিজিটাল সঞ্চয়পত্র' কিংবা 'শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ'। কারণ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে ট্র্যাকিং, লভ্যাংশ, এবং সর্বোপরি স্বচ্ছতা।
অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ, আস্থা ফেরাতে দরকার তিনটি পদক্ষেপ
> পুরস্কারপ্রাপ্তদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ
> ড্র পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত
> বন্ড ভাঙানো প্রক্রিয়া সহজ ও হয়রানিমুক্ত করা
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনালী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'যে কোনো রাষ্ট্রীয় আর্থিক পণ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা অত্যন্ত জরুরি। পুরস্কারপ্রাপ্তদের পরিচয় গোপন রেখে কার্যত একটি অস্বচ্ছ লটারির মতো করে ফেলা হয়েছে প্রাইজবন্ডকে। বিশ্বজুড়ে যেখানে ফিনটেকের জয়জয়কার (আর্থিক প্রযুক্তি বা ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি), সেখানে প্রাইজবন্ড নিয়ে এখনো যদি হাতে লিখে ফরম পূরণ করতে হয়, সেটা সময়ের সঙ্গে তাল না মেলানোর উদাহরণ।'
অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমরান উদ্দিন চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, 'প্রাইজবন্ড মূলত ছিল এক ধরনের 'নন-ইন্টারেস্ট বিয়ারিং ইনস্ট্রুমেন্ট', যার মাধ্যমে সরকার জনগণের কাছ থেকে ঋণ নেয়। কিন্তু এখন সেই ঋণ নেয়ার পদ্ধতিও হতে হবে জবাবদিহিমূলক।'
তিনি আরও বলেন, 'যেখানে মোবাইল ফিনান্স, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল সঞ্চয়পত্রে স্বচ্ছতা ও ট্র্যাকিং সুবিধা আছে, সেখানে প্রাইজবন্ডের মতো অন্ধ ড্র সিস্টেম সাধারণ মানুষের আস্থা হারাবেই।'
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আলেয়া আক্তার চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, প্রাইজবন্ড একসময় প্রয়োজনীয় ছিল, যখন দেশের মানুষের সঞ্চয়ের বিকল্প মাধ্যম সীমিত ছিল। কিন্তু এখন মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল ট্রেজারি বন্ড, ইটিএফ এমন অনেক আধুনিক ও স্বচ্ছ সিস্টেম আছে। পুরোনো কাগুজে বন্ডে এখন জনগণের আগ্রহ হারানো অস্বাভাবিক নয়। সবচেয়ে দুঃখজনক, সরকার এই মাধ্যমটিকে আপডেট করার চেষ্টা করেনি। যেভাবে সঞ্চয়পত্রে স্বয়ংক্রিয়তা এসেছে, তা প্রাইজবন্ডে নেই।'
Comments