মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্বে বিএনপির শক্ত ঘাঁটিতে অস্থিরতা বাড়ছে
নওগাঁ-২ (পত্নীতলা–ধামইরহাট) আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই এলাকায় রাজনীতির বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক শামসুজ্জোহা খান জোহাকে প্রার্থী ঘোষণা করার পর গত দুই সপ্তাহে দুই উপজেলায় ক্ষোভ, অসন্তোষ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে তৃণমূল পর্যায়ে। প্রায় প্রতিদিনই মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে মনোনয়নবঞ্চিত নেতা খাজা নাজিবুল্লাহ চৌধুরীর সমর্থকদের উদ্যোগে।
নজিপুর ও ধামইরহাটে ১৯টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌর এলাকার নানা স্থানে নেতাকর্মীদের সমাবেশ, ব্যানার–ফেস্টুন, স্লোগান স্পষ্ট করে দিচ্ছে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণাকে ঘিরে বিএনপির অভ্যন্তরে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীর অভিযোগ, শামসুজ্জোহা খান জোহাকে প্রার্থী নির্বাচন করার সময় মাঠের বাস্তবতা এবং দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাদের মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং আন্দোলনে অনুপস্থিত থাকা, আওয়ামী লীগপন্থী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে তথাকথিত 'পকেট কমিটি' গঠন এসব অভিযোগ নতুন করে উসকে দিয়েছে আস্থাজনিত সংকট।
নজিপুর জিরোপয়েন্টে দুই কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন
গত সোমবার নজিপুর জিরোপয়েন্ট এলাকায় এক মানববন্ধনে দুই কিলোমিটারব্যাপী সড়কের দুইপাশে দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষ ব্যানার-ফেস্টুন হাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, মহিলা দল ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী ছাড়াও অনেক সাধারণ মানুষ অংশ নেন। সমাবেশে বক্তারা অভিযোগ তোলেন "আন্দোলনের মাঠে যাদের দেখা যায়নি, তাদের দিয়ে বিএনপি জিতবে কীভাবে?"
মানববন্ধনের আগে কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে এক বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন নজিপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, "মনোনয়ন দিতে হলে তৃণমূলের মতামত জানতে হয়। যারা বছরের পর বছর রাস্তায় ছিলেন, আজ তাদের বাদ দিয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রার্থী করলে তৃণমূলে ক্ষোভ বাড়বেই।"
বিক্ষোভ সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, পত্নীতলা উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সাবেক সদস্য মিজানুর রহমান মিজান, ধামইরহাট উপজেলা বিএনপির সদস্য রেজাউল ইসলাম, ধামইরহাট মহিলা দলের সহ-সভাপতি নাহিদা সুলতানা, জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবি দল ধামইরহাট শাখার আহবায়ক রকিবুল হাসান, শ্রমিকদলের জাহিদুল ইসলাম, পত্নীতলা উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য আবু তাহের মন্টু, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম প্রমুখ।
পকেট কমিটি, মাঠে অনুপস্থিতি জোহার বিরুদ্ধে অভিযোগের ঝড়
সমাবেশে বক্তারা বলেন, উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে জোহা তাঁর ঘনিষ্ঠ জনকে দিয়ে 'পকেট কমিটি' গঠন করেছেন। এতে প্রকৃত নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হয়েছেন। বক্তারা অভিযোগ তোলেন ২০০৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন ও আন্দোলনের সময় জোহা কখনো মাঠে আসেননি। গ্রেফতার, মামলা, হামলা এসবের মুখে প্রকৃত ত্যাগী নেতারা যখন লড়াই করে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন 'নিরাপদ দূরত্বে'। তৃণমূলের একাধিক নেতা বলেন, "দল করতে হলে রাস্তায় নামতে হয়। ঘোষণায় নেতা হওয়া যায় না।"
'গ্রেফতারি পরোয়ানা' কর্মীদের নতুন ক্ষোভ
স্থানীয় নেতারা দাবি করছেন, শামসুজ্জোহা খানের বিরুদ্ধে একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এ বিষয়ে কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও তৃণমূলে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কর্মীদের প্রশ্ন "যার বিরুদ্ধে পরোয়ানা আছে, তাকে প্রার্থী দিলে নির্বাচনী মাঠে সমস্যা তৈরি হবে না?"
এই প্রশ্ন নিয়মিতই উঠে আসে মিছিল, সমাবেশ ও মানববন্ধনে।
৫ আগস্টের পর ঘটনা 'মামলার ভয় দেখিয়ে বাণিজ্য' অভিযোগ তৃণমূলের আরেকটি বড় অভিযোগ ৫ আগস্টের ঘটনার পর বালুচর দখল ও আওয়ামী লীগপন্থী নেতাদের মামলার ভয় দেখিয়ে আর্থিক বাণিজ্য করেছিলেন জোহা। এ কারণে এলাকায় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আতঙ্ক ও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষায় "এমন নেতাকে নিয়ে ভোট চাইতে যাওয়া খুবই কষ্টকর। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।" অভিযোগ আছে এইসব বিতর্কের কারণে তিনি এখন সম্পূর্ণরুপে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
'মাঠে আমরা ছিলাম, জোহা ছিলেন না' এটাই তৃণমূলের ক্ষোভের মূল
উপজেলা যুবদল, মহিলা দল ও মৎস্যজীবী দলের নেতারা বলেন ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২০ পরবর্তী বিএনপির আন্দোলনে পত্নীতলা-ধামইরহাটের মাঠে তাঁরা খাজা নাজিবুল্লাহর নেতৃত্বেই ছিলেন। এক যুবদল নেতা বলেন, "মাঠে যাকে পাই, তাকেই চাই। আন্দোলনে যে ছিল, সে-ই আমাদের প্রার্থী হওয়া উচিত।"
নেতাকর্মীরা মনে করেন, নাজিবুল্লাহ ত্যাগী, কারানির্যাতিত এবং তৃণমূল পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য তাই তাকে সরিয়ে এমন প্রার্থী ঘোষণা করা অযৌক্তিক। নেতাদের বক্তব্য "তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে"
বিক্ষোভে সভাপতিত্বকারী নজিপুর পৌরসভার সাবেক পৌর মেয়র আনোয়ার হোসেন বলেন, "তৃণমূলের মতামত অগ্রাহ্য করে একজন বিতর্কিত নেতাকে প্রার্থী করা হয়েছে। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে হবে।"
ধামইরহাট উপজেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক রুহুল আমিন বলেন, "২০১৪ সাল থেকে আমরা রাস্তায় ছিলাম। কে কোথায় ছিলেন, তা তৃণমূল জানে। তাই মানুষের দাবি স্পষ্ট নাজিবুল্লাহই প্রার্থী হওয়া উচিত।"
মনোনয়নবঞ্চিত খাজা নাজিবুল্লাহ চৌধুরী বলেন, "সব আন্দোলনে মাঠে ছিলাম। দল কঠিন সময়ে যেমন ছিলাম, ভবিষ্যতেও থাকব। পুনর্বিবেচনা হলে মনোনয়ন পাওয়া সম্ভব, তবে দলই সবার আগে।" তাঁর এই সংযত অবস্থান কর্মীদের আরও উৎসাহিত করেছে।
জোহা কি মাঠে নামতে পারবেন?
স্থানীয় নেতারা বলছেন "তাঁকে নিয়ে মাঠে নামতে গেলে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে বিএনপি নিজেই নিজেদের ভোটভিত্তি দুর্বল করে ফেলবে।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন "যে আসনটি বিএনপির সম্ভাবনাময়, সেখানে প্রার্থীকে ঘিরে বিভাজনই দলকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।"
দ্বন্দ্বে সুযোগ দেখছে জামায়াতে ইসলাম
নওগাঁ-২ আসন দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির জন্য শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। তবে স্থানীয়দের দাবি প্রার্থী নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিভাজন গভীর হলে এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে একই আসনে মাঠে থাকা জামায়াতে ইসলামের মনোনীত প্রার্থী এনামুল হক। ইতোমধ্যেই তৃণমূলের বিভক্তি কাজে লাগিয়ে জামায়াত মাঠে তৎপরতা বাড়িয়েছে।
একাধিক মধ্যম সারির বিএনপি নেতা বলেন "যদি এ বিভাজন অব্যাহত থাকে, তবে জামায়াতই লাভবান হবে। ঐক্যহীন অবস্থায় নির্বাচনমুখী হওয়া বিএনপির জন্য ঝুঁকি।"
স্থানীয়দের ভাষায় "সমঝোতা না হলে ভোটের লাভ হবে জামায়াতের। তৃণমূল যতটা বিভক্ত হবে, প্রতিদ্বন্দ্বী ততটাই শক্তিশালী হবে।"
নওগাঁ-২ আসনে প্রাথমিক মনোনয়নকে ঘিরে বিএনপির ভেতরকার অস্থিরতা দিন দিন গাঢ় হচ্ছে। প্রতিদিনের বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও ক্ষোভ-অসন্তোষ স্পষ্ট করছে দল এখন প্রার্থী সংকট নয়, বরং আস্থা ও নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। তৃণমূলের বিরোধিতা উপেক্ষা করলে তা বড় ধরনের বিভাজনে রূপ নিতে পারে যার প্রভাব পড়বে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের মাঠেও।
Comments