ঘাট ধ্বংস হয়ে মোংলার ৫০ হাজার মানুষের যাতায়াত বিপন্ন

সকালের আলো ফোটার আগেই মোংলা নদীর তীরে জড়ো হন শত শত মানুষ—নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশু। সকলের চোখ নদীর দিকে, অপেক্ষা কখন কোনভাবে পার হওয়া যাবে। একসময়ের স্থায়ী পাকা ঘাটটি ধসে যাওয়ার পর থেকে মোংলায় প্রতিটি সকাল শুরু হয় উৎকণ্ঠা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে। ইপিজেড, বন্দর কিংবা কারখানাগুলোতে যাওয়া মানুষের যাতায়াত এখন জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ এক যাত্রা।
মোংলা পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই পাকা ঘাটটি এক সময় ছিল শত শত শ্রমজীবী মানুষের একমাত্র নির্ভরতা। কিন্তু নদীর প্রবল স্রোত, ভাঙন এবং দীর্ঘদিনের অবহেলায় ঘাটটির অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। আজ সেখানে নেই কোনও নিরাপদ ব্যবস্থা। বিকল্প হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে একটি অস্থায়ী কাঠের পোল—যা সরু, ঝুঁকিপূর্ণ এবং মানবেতর। নারী শ্রমিকদের জন্য এই যাত্রা আরও বিপজ্জনক—সকালবেলা বর্ষার জলে ভেজা পাটাতনে ভারসাম্য রেখে হাঁটা, অপমানজনক মন্তব্য, কখনো কখনো আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
এই বাস্তবতায় মোংলা পোর্ট পৌরসভা চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বিশেষ বরাদ্দ থেকে একটি পন্টুনসহ পূর্ণাঙ্গ ঘাট অবকাঠামো নির্মাণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে জরুরি প্রশাসনিক অনুমোদন চেয়েছে।
পৌরসভা সূত্র জানায়, গত ৩০ এপ্রিল পৌর প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়। সরকার সাড়া দিয়ে ১ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ দেয়, তবে সেটি শুধুমাত্র রাস্তা-ঘাট, ড্রেন বা কালভার্ট সংস্কারের জন্য বরাদ্দ করা হয়। ফলে নদীপথে পারাপারের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘাট নির্মাণের বিষয়টি থেমে যায়।
তবে জনদাবি, বাস্তব চাহিদা ও মানবিক বিবেচনায় পৌর পরিষদ সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়—পন্টুন ছাড়া ঘাটে জনগণের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা যাবে না। সম্প্রতি পৌরসভায় অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এলাকার শিক্ষক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী নেত্রী, শ্রমিক প্রতিনিধি ও সাধারণ নাগরিকরা বলেন—"এই ঘাট আমাদের জীবনরেখা। শিশুর স্কুলে যাওয়া, রোগীকে হাসপাতালে নেওয়া, শ্রমিকের কর্মস্থলে পৌঁছানো—সব কিছুই এই ঘাটের উপর নির্ভর করে। এটি আর বিলম্ব সহ্য করছে না।"
মোংলার কৃতি সন্তান, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে তিনি ঘাটের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন—"আমি মোংলার সন্তান। জানি, এই ঘাট কেবল যাতায়াতের স্থান নয়—মানুষের জীবনের অংশ। একজন নারী শ্রমিক যখন ঘাটে এসে দাঁড়ান, তার পেছনে থাকে সন্তান, সংসার, স্বপ্ন। আমরা যদি সেই ঘাটটুকু ফিরিয়ে দিতে না পারি, তবে উন্নয়ন কিংবা মানবিকতার কথা বলাটাও অর্থহীন হয়ে পড়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি, আশা করি শিগগিরই সুখবর দিতে পারব।"
আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে পৌর পরিষদের সিদ্ধান্তের অনুলিপি, মতবিনিময় সভার কার্যবিবরণী এবং ঘাট এলাকার দুরবস্থার স্থিরচিত্র। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসকের যৌথ স্বাক্ষরিত আবেদনে বলা হয়েছে—"এই অনুমোদন দ্রুত পাওয়া গেলে মানুষ স্বস্তি পাবে। জনস্বার্থে পন্টুনসহ ঘাট অবকাঠামো নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।"
Comments