সংবাদমাধ্যমের এ সময়ের বিপন্নতা ইতিহাস মনে রাখবে
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে বর্তমান সময়টি দাগ দিয়ে যাচ্ছে। এখন প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিক, সম্পাদক আর সমাজের সুশীল অংশ রাজপথে নামছে, লিখছে, বলছে। তাদের বিষয় - সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাঁচাবার প্রয়োজন এবং তার জন্য জনসাধারণের সমর্থনের প্রয়োজন। এমন অভূতপূর্ব ঐক্যের কারণটি অবশ্যই গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। সেদিন এক দল উগ্রপন্থি দেশের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা অফিস প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার ভবনে হামলা করে, আগুন ধরিয়ে দিয়ে সাংবাদিক ও কর্মীদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছে। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীরকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতি উগ্রবাদীদের এমন সহিংসতায় সাংবাদিকরা বিপন্ন বোধ করছেন। গত বছর জুলাই আন্দোলনে এই পত্রিকা দুটি শেখ হাসিনার পতনে বড়ো ভূমিকা রেখেছে। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনার পুরো শাসনামলেই তারা তার দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। আর এ জন্য তাদের সরকারি নিপীড়নও ভোগ করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের পরই তাহলে এই পত্রিকা দুটি কেন টার্গেট হলো?
বলে রাখা ভাল, শুধু এই দুটি পত্রিকা নয়, সেদিন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে দেশের সাংস্কৃতিক আইকন ছায়ানট এবং গণমানুষের সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর অফিসও। ফলে বিষয়টি পরিষ্কার যে, হামলাকারীদের টার্গেট সব সেকুলার প্রতিষ্ঠান।
হামলাকারীরা এই সমাজে বাস করা রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে বড়ো হওয়া একটি গোষ্ঠী, যারা সহিংসতার মাধ্যম রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলে নিতে চায়। তারা বলতে চায় তাদের মত যারা কথা না বলবে, আচরণ না করবে, যারা তাদের স্লোগান, তাদের নায়ক, তাদের ইতিহাসের বয়ান পুরোপুরি মেনে নেবে না, সবাই শত্রু। সবাই হত্যাযোগ্য।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, সবাই মন খুলে সরকারের সমালোচনা করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই বলা যাচ্ছে না। বলছে কেবল একটি গোষ্ঠী যারা কথায় কথায় জান নিয়ে নিতে চায়। কথায় মব ভায়োলেন্স করে জীবন্ত মেরে ফেলতে চায় মানুষকে। তাই ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম-কে এখন বলতে হয়, "মত প্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাই দায়"।
সংবাদমাধ্যম তথা গণতন্ত্রের বিপন্নতা রুখতে তাই জোট বেঁধেছে সাংবাদিকরা। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সংবেদনশীল রাজনীতিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম প্রয়োজন, তা আজ স্পষ্ট। কিন্তু লড়াইয়ের উপায়টা কী? গণতন্ত্রের পথ যদি কঠিন হয়ে যায়, তাহলে সংবাদমাধ্যম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ইতিহাস মনে রাখবে। ইতিহাস কেবল ঘটনা লিপিবদ্ধ করে না, সে চরিত্রও বিচার করে। কোন সময়ে কারা নীরব ছিল, কারা ক্ষমতায় থেকেও দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে, ইতিহাস সেসব খুব নির্মমভাবে মনে রাখে। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এমন একটি অধ্যায় যুক্ত হয়ে গেল, যেখানে সংবাদমাধ্যম পুড়িয়ে দেওয়া হলো, সাংবাদিকদের পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হলো, আর রাষ্ট্রযন্ত্র দাঁড়িয়ে রইল অসহায় দর্শকের ভূমিকায়।
ইতিহাস মনে রাখবে এই সময়ের কথা যখন শত শত সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ভুয়া হত্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে মাসের পর পর, জেলে বন্দী করে রেখে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে সম্পাদক ও সাংবাদিকের সাথে। এগুলো ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন দেশের সরকার প্রধান ছিলেন একজন নোবেল বিজয়ী, যার নাম বিশ্বজুড়ে নৈতিকতা, মানবতা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সংস্কৃতিমন্ত্রী ছিলেন একজন খ্যাতিমান নির্মাতা, যাঁর কাছ থেকে সংবেদনশীলতা ও সৃজনশীল প্রতিবাদের প্রত্যাশা করা অস্বাভাবিক ছিল না। সরকারের প্রভাবশালী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন মানবাধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী; আইনমন্ত্রী ছিলেন একজন অধ্যাপক - শাসন ও নৈতিক দায়িত্ব যাঁর জীবনের মূল দর্শন বলে মনে করা হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন সামরিক বাহিনীর একজন জেনারেল, আর সরকারি মুখপাত্র ছিলেন একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক। শুধু তাই নয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বহু পদেই ছিলেন দেশের পরিচিত সাংবাদিকরা।
এমন পরিস্থিতি, সাংবাদিকদের সাথে এমন আচরণ কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, গভীর নৈতিক অপরাধ। সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের স্তম্ভ - এই বাক্যটি বহুবার বলা হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনার পর তা যেন কেবল পাঠ্যবইয়ের লাইন হয়ে রইল। যখন রাষ্ট্র নিজেই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়, যখন আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাবানরা নীরব থাকে, তখন সেই রাষ্ট্র তার গণতান্ত্রিক দাবিও হারাতে বসে।
ইতিহাস এই অধ্যায় ভুলবে না। নামগুলো খুব ঠান্ডা মাথায়, নির্মমভাবে লিখে রাখবে - কে ক্ষমতায় ছিল, কে নীরব ছিল, কে প্রতিবাদ করেনি। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রশ্ন করবে এত মানবাধিকারকর্মী, এত সাংবাদিক, এত বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে ক্ষমতায় থেকেও কেন আগুন থামানো গেল না? কেন সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস কারও হলো না? কেন সাংবাদিক নিপীড়ন বন্ধ করা হলো না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়ত কখনো দেওয়া হবে না। কিন্তু ইতিহাস তার রায় দিয়ে দেবে- নীরবতাও এক ধরনের অপরাধ, সেই অপরাধের দাগ ক্ষমতার সব অলংকার ছাপিয়ে চিরকাল রয়ে যায়।
Comments