" গহন সংঘাত ও অদৃশ্য ভূখণ্ড "
ধানমন্ডির পুরোনো, শ্যাওলা ধরা পাঁচতলা ফ্ল্যাটটির সামনে দাঁড়ালেই বোঝা যায়—কালের ছাপ যেমন দেয়ালের রঙ চেটে নিয়েছে, তেমনই সময় মানুষের মনেও বসিয়ে দিয়েছে অদৃশ্য কোনো দাগ। আনোয়ার এখানে থাকেন প্রায় পনেরো বছর ধরে। এই ফ্ল্যাট তাঁর কাছে শুধু আশ্রয় নয়, বরং শহরের বুকে একটি ক্ষুদ্র, কিন্তু জীবন্ত সামাজিক মানচিত্র। এখানে আছে বৃদ্ধ সেলিনা খালা, যিনি প্রতিদিন বিকেলে বারান্দা থেকে কবুতরদের ডেকে ডেকে দানা ছিটান। আছে তৃতীয় তলার বাচ্চা মেঘ ও তাহমিনা, যাদের হাসির শব্দে মাঝে মাঝে আশপাশের ক্লান্তি একটু হালকা হয়। আর আছে একদম নিচতলার একাকী ভদ্রলোক—রফিক সাহেব, যিনি আড়াই বছর আগে মারা যাওয়া তাঁর পুরোনো পোষা বিড়াল "মিটু"-র নাম ভুলতে পারেন না আজও।
এই মাল্টিস্টোরি ফ্ল্যাট আর এখানকার মানুষগুলো যেন প্রকৃতির কোনো বড় নাটকের নিরবে অপেক্ষমান চরিত্র। কে জানতো, সেই অপেক্ষা করা মানুষগুলো একদিন সত্যিকার অর্থে অভিনয় করতে বাধ্য হবে—নিজেদের অজান্তে, নিজেদের তৈরি সামাজিক মঞ্চে।
সন্ধ্যা তখন ধীরে ধীরে নামছে। আনোয়ার বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। শহরের কোলাহলের ভেতরেও এক ধরনের নীরবতা এসে ভিড় জমিয়েছিল। দূরে আজানের সুর, রাস্তার কুকুরের ঘেউ-ঘেউ, আর পাশের ছাদে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধের লাঠির খটখট শব্দ—সব মিলিয়ে যেন শহরের একটা নিজস্ব ছন্দ তৈরি করেছে।
ঠিক তখনই পৃথিবী যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইল। প্রথমে ছিল অদ্ভুত এক নীরবতা। তারপর যেন ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা ধাতব গর্জন—হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়া কাঁপুনি। সিলিং ফ্যান হঠাৎ দুলতে শুরু করল, জানালার কাঁচ কাঁপতে লাগল আর আলমারির ভেতর বইগুলো থরথর করে উঠল।
শব্দ, আলো, শব্দহীনতা, চিৎকার—সব মিলিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পৃথিবী যেন নিজের হাড়গুলো ঝাঁকিয়ে উঠল।
এটি শুধুই ভূমিকম্প ছিল না। এটি ছিল এমন এক কম্পন—যা প্রকৃতির নিচে লুকিয়ে থাকা সত্যকে আর মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভয়কে একসঙ্গে ঝাঁকুনি দিল।
দোতলার ফ্ল্যাটের ভেতরে হুড়োহুড়ি লেগে গেল। রান্নাঘরের থালা-বাটি ঝনঝনিয়ে উঠছে, বাচ্চাদের চিৎকার, দরজায় ধাক্কাধাক্কি, আতঙ্কে সবার হাতপা গুলিয়ে যাচ্ছে। আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছেলে আদিলকে কাঁধে তুলে নিলেন, আর চিৎকার করে বললেন,
"লুবনা, নওশিন! এখনই নেমে আসো! সিঁড়ি ভেঙে পড়তে পারে!"
বুক ধুকপুক করছে, সিঁড়ি তখন মানুষের ভিড়ে ভরে উঠছে। পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ সেলিনা খালা হাঁটতে পারছেন না। তাঁর হাত ধরে নিচে নামাচ্ছেন অনিকের মা। আর পাশেই দেখা গেল—তৃতীয় তলার ছোট্ট মেঘ তার পোষা খরগোশ 'টুটু'কে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কাঁদছে, "এটা ফেলে যাব না! এটা আমারও বাঁচার সঙ্গী!"
সামনে তখন জীবন বাঁচানোর লড়াই। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, বাইরের দরজায় এসে লুবনা হঠাৎ থেমে গেলেন।
"আমার চাদরটা…"—এতটাই মৃদু স্বর, যেন পৃথিবীর সব শব্দের কোলাহলের ভেতরও সেটাই সবচেয়ে স্পষ্ট।
ভূমিকম্পের ভয় নয়, বরং সামাজিক ভয়। মৃত্যুর ঝুঁকি নয়, বরং সম্মান হারানোর অদৃশ্য শঙ্কা।
নওশিনও ফিরে গেল তার সঙ্গে—কোনো বিতর্ক নেই, কোনো প্রশ্ন নেই, ছিল শুধু এক পুরোনো প্রোথিত অভ্যাস। যেন পৃথিবীর সব কম্পনের থেকেও শক্তিশালী এক ভূখণ্ড আছে, যা অদৃশ্য হলেও শাসন করে আমাদের সিদ্ধান্তকে।
এই দৃশ্যটা একবার চোখে পড়া মানেই যেন ফেলা যায় না মন থেকে। আনোয়ার সেই মুহূর্তে বুঝলেন, মানুষ শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে নিজেকে বাঁচায় না, বরং চেষ্টা করে বাঁচাতে তার সামাজিক পরিচয়কে।
আর সেই পরিচয়ের সবচেয়ে দুর্লঙ্ঘনীয় দেয়ালটি দাঁড়িয়ে আছে নারীর সামনে।
ঠিক তখন নিচতলার বৃদ্ধ রফিক সাহেব নিজের পোষা বিড়াল "ঝুমা"-টিকে কোলে নিয়ে দৌড়ে নামতে নামতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। তাঁর হাঁটু ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে। অনিকের বাবা তাঁর হাত ধরে নিচে নামাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বয়সী মা-বাবাকে নামাতে গিয়ে সময় হারাচ্ছেন, বিপদ বাড়াচ্ছেন। আর মেঘ এখনো কাঁদছে—"আমার খরগোশকে ফেলে যাব না!"
সচেতন মানুষেরাও তখন বুঝলেন—বিপর্যয়ের মুহূর্তেও আবরণ আর আবেগ, কর্তব্য আর ভালোবাসা, পর্দা আর জীবন—এই সবগুলো জটিল মানচিত্র মানুষের ভেতরে খুব নিঁখুতভাবে আঁকা আছে।
একজন তরুণী, যিনি বোরকা নিতে গিয়েছিলেন ফিরে, সিঁড়িতে প্রায় অচেতন হয়ে পড়লেন। কেউ পানি দিল, কেউ সাহায্য করল। কিন্তু তাঁকে ঘিরে থাকা নারীরা উল্টো ফিসফিস করে বলছিলেন, "যতই হোক, পর্দা না নিয়ে বের হওয়া ঠিক হয়নি।"
সন্দেহ নেই, এটাই সেই অদৃশ্য ভূমিকম্প—যা প্রকৃতি নয়, সমাজ সৃষ্টি করেছে।
নিচের খোলা মাঠে যখন সবাই একত্র হলো, তখন আকাশে আর ভূকম্পন নেই, কিন্তু মানুষের মনে এখনো ভয়, অপূর্ণতা আর প্রচ্ছন্ন প্রশ্নের ঢেউ।
সেলিনা খালা কাঁপা হাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, "আমি বুঝতে পারি, বয়স হলে জীবন থেকেও বেশি ভয় পাই আমরা—একাকিত্বকে, অসম্মানকে, অবহেলাকে।"
তার কথা শুনে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অনিক বলল, "দাদি, আমি আছি তো আপনার পাশে।" সেই শিশুসুলভ নিশ্চয়তায় যেন কিছুটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল।
আর ঠিক তখনই নওশিন কান্নাভেজা চোখে বাবাকে বলল, "বাবা, আমরা ফিরে গেলাম কেন? বোরকা না পরে বের হওয়াটা কি জীবনের চেয়েও বড় ভুল?"
এ প্রশ্নের উত্তর শুধু একজন বাবার নয়, পুরো সমাজের দরকার। কিন্তু আনোয়ার নিরুত্তর।
তিনি লুবনার দিকে তাকালেন। সেখানে আছে অব্যক্ত লজ্জা, অন্ধকার দ্বিধা, আর এক ধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতা, যা ভূমিকম্পে তৈরি হয়নি; তৈরি হয়েছে শত বছরের সামাজিক শিক্ষায়।
হাত ধরলেন আনোয়ার। নীরবে। কোনো বাক্য নয়, কোনো তর্ক নয়। সেই স্পর্শই ছিল তাঁর প্রথম প্রতিবাদ।
ঘরে ফিরে সবকিছু এলোমেলো। বই, ফুলদানি, আয়না। কিন্তু তাদের ভেতরে যেন কোথাও কোনো ক্লান্তি নেই। বরং এক অদ্ভুত নীরব আলো ছড়িয়ে আছে।
রাতে ডায়েরি লিখলেন আনোয়ার—
"ভূমিকম্পে দুলে উঠেছিল ঘর, কিন্তু দুলেনি আমাদের সামাজিক নিয়ম। প্রকৃতি কাঁপলেও নড়েনি অভ্যন্তরের দেয়াল। নারীর পর্দা, বয়স্কের একাকিত্ব, শিশুর আবেগ, পোষা প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্ক—এই সবকিছুই যেন জীবনের চেয়েও বড় হয়ে উঠল আজ।"
লুবনা এসে পাশে বসে বললেন, "আমি জানি, আমি ভুল করেছি। কিন্তু সেটা শুধু কাপড়ের ভুল নয়। এ ভুল আমি একা করি না—আমাদের সবার ভেতরেই যেন জন্মায় এমন এক ভয় যে—আমরা যা দেখাই, তা-ই যেন আমরা।"
আনোয়ার বললেন, "কিন্তু আজ যে ভয় তুমি অনুভব করলে, সেটাই আসল ভূমিকম্প।"
সেই নীরব বাক্যটিতে যেন লুবনা নিজের অদেখা ভূখণ্ডে প্রথম আলোর রেখা দেখতে পেলেন।
পরেরদিন শহরের রিপোর্টে ছাপা হলো—"৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প, কয়েকটি ভবনে ফাটল, ক্ষয়ক্ষতি সীমিত।"
কিন্তু কোনো সংবাদেই লেখা হলো না— "অদৃশ্য সামাজিক সীমানায় কেঁপে উঠেছে আরও গভীর কোনো ভূখণ্ড।" কিন্তু কেঁপে উঠেছিল।
আর সে কাঁপন শুধু বাড়ি ভাঙেনি— ভেঙেছে বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি, আর দীর্ঘচর্চিত নিয়মের অন্ধকার ঘেরাটোপ।
আর সে কাঁপন এখনো থামেনি।
কারণ, যে ভূমিকম্প সবচেয়ে গভীর,
সে কখনো শুধু মাটি কাঁপায় না—
সে কাঁপায় শেকল বাঁধা চিন্তা।
যেদিন কাঁপতে শুরু করে ভিতরের অদৃশ্য ভূখণ্ড—
সেদিনই শুরু হয় সত্যিকারের মুক্তি।
Comments