রাজতন্ত্র ফিরছে নেপালে?

প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির ইস্তফা তথা সরকার পতনের পরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি নেপালে। রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী, চলছে কারফিউ। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে সেনাবাহিনী। আনুষ্ঠানিক ভাবেই নেপালের দায়িত্ব এখন দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে। বিবৃতি দিয়ে জানানো হল,যত দিন পর্যন্ত না নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে, তত দিন দেশের শাসনভার চালাবে তারা।
এই যে এমন রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলন যার সূচনা জেন-জি প্রজন্মের হাত ধরে,তার লক্ষ্য কী? সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধ করায় তরুণ প্রজন্ম ক্ষেপে উঠলেও আসল কারণ ছিল কে পি শর্মার সরকারের মন্ত্রী,এমপি ও আমলাদের ব্যাপক দুর্নীতির। শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভেই সব শ্রেণি পেশার মানুষ নেমে এসেছে রাজপথে। গুলি করেও তাদের থামানো যায়নি। মানষের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে শাসকদের বাড়িঘরে, প্রাণ গেছে তাদেরও।
একটা প্রশ্ন উঠেছে, এখন নেপালের গন্তব্য কোথায়? রাজতন্ত্র হটিয়ে, হিন্দু রাষ্ট্রের তকমা সরিয়ে সমাজতন্ত্রীরা যে সেক্যুলার নেপাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা আর থাকছে না। বলা হচ্ছে, নেপাল আবার রাজতন্ত্রে ফিরছে। রাজতন্ত্র ফিরলে হিন্দু রাষ্ট্রের পরিচিতিও ফিরে আসবে।
প্রকৃতপক্ষে নেপালের রাস্তাঘাট প্রায় পুরো ২০২৫ জুড়েই অস্থির ছিল। মার্চে কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ শুরু হয়, যেখানে আন্দোলনকারীরা রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশকে আবার হিন্দু রাষ্ট্রে ফেরানোর দাবি তোলে। একই সঙ্গে তারা কেপি শর্মা অলি সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে।
গত সপ্তাহে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ঘিরে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দেয়। এরপর সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিলে তা স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করে, হাজার হাজার তরুণকে আবার রাস্তায় নামিয়ে আনে ৮ সেপ্টেম্বর। পুলিশের দমন-পীড়নে ১৯ জন নিহত হয়।
ক্রমবর্ধমান জনচাপে সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে বাধ্য হলেও ততক্ষণে আন্দোলন সরকারকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ও জনগণের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের মুখে কেপি শর্মা অলি মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ একজন সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনযাপন করছেন। তার প্রধান বাসস্থান কাঠমান্ডুর নির্মল নিবাস। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে তিনি শহরের উপকণ্ঠে নাগার্জুন পাহাড়ে হেমন্তাবাস নামে একটি কটেজে আংশিকভাবে বসবাস শুরু করেন, যা একটি শিকার লজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রানী মা রত্না এখনো প্রাক্তন রাজপ্রাসাদ কমপ্লেক্সের মধ্যে মহেন্দ্র মঞ্জিলে থাকেন।
রাজপরিবারের তরুণ সদস্যরা দেশের বাইরে থাকেন। সাবেক যুবরাজ পরশ এবং যুবরানী হিমানির কন্যা রাজকুমারী কৃতিকা শাহ ২০০৮ সালের জুলাই মাসে পরিবারসহ নেপাল ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান,যেখানে তিনি এখনও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বড় বোন রাজকুমারী পূর্ণিকা শাহও একই সময়ে নেপাল ছাড়েন এবং বর্তমানে সিঙ্গাপুরেই রয়েছেন।
মার্চে জ্ঞানেন্দ্র শাহ যখন পোখরা থেকে কাঠমান্ডু ফিরে আসেন, তখন হাজারো রাজতন্ত্রপন্থী সমর্থক তাকে স্বাগত জানান। পরিবার-পরিজন নিয়ে তিনি নির্মল নিবাসে যান। মে মাসে তিনি তার নাতি হৃদয়েন্দ্রকে (যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরেছিলেন) সঙ্গে নিয়ে নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদে যান। সেখানে পরিবার মিলে প্রাসাদ চত্বরে পূজা দেন।
মার্চের বিক্ষোভগুলোতে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়, যারা স্লোগান দেয়: 'ফিরে আসুন রাজা, দেশকে বাঁচান'। এসব রাজতন্ত্রপন্থী স্লোগানের পাশাপাশি তারা অলি'র পদত্যাগও দাবি করে। কেউ কেউ রাজপ্রাসাদে প্রবেশের চেষ্টা করে, এতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দুইজন নিহত ও একশ'র বেশি আহত হয়।
মে মাসে নবরাজ সুবেদীর নেতৃত্বে রাজতন্ত্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো সারাদেশে আন্দোলন শুরু করে। কর্তৃপক্ষ জুলাই পর্যন্ত নারায়ণহিতি প্রাসাদ জাদুঘরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এদিকে, ক্ষমতাসীন নেপাল কম্যুনিস্ট পার্টি সিপিএন-ইউএমএল দল প্রজাতন্ত্রব্যবস্থা রক্ষায় পাল্টা-বিক্ষোভ আয়োজন করে, বিশেষত প্রজাতন্ত্র দিবসে।
প্রাক্তন রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ এই আন্দোলনে উজ্জীবনী ভূমিকা রেখেছেন। তার কাঠমান্ডুতে উপস্থিতি হাজারো সমর্থককে আকৃষ্ট করেছে। যদিও তিনি সিংহাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি জানাননি, তার উপস্থিতিই রাজতন্ত্রপন্থীদের সংগঠিত করছে। রাষ্ট্রীয় প্রজাতান্ত্রিক পার্টি (আরপিপি) রাজতন্ত্রকে শাসনক্ষমতা হিসেবে নয়,বরং জাতীয় স্বার্থের রক্ষক হিসেবে সমর্থন করে।
জেন-জি আন্দোলন শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক মাস পরেই, যখন রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি রাজতন্ত্রপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং অ্যান্টি-ফেডারালিস্টদের সঙ্গে মিলে কাঠমান্ডুতে ব্যাপক 'রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা' সমাবেশ করেছিল। দশ-হাজারেরও বেশি প্রতিবাদকারী রাস্তায় নেমে পড়েছিল, তারা বিলুপ্ত রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সাবেক রাজাকে রাষ্ট্রপ্রধান করার দাবিতে সরব হয়েছিল। প্রতিবাদকারীরা আরও দাবি তোলে নেপালে হিন্দুধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করার। তারা স্লোগান দেয় – 'রাজা ফিরতে হবে'।
২০০৮ সালে, নেপালের ২৪০ বছরের শাহ বংশের পতাকা কাঠমান্ডুর প্রধান প্রাসাদ থেকে নামিয়ে আনা হয়, যখন বিশ্বের শেষ হিন্দু রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়। এর দুই বছর আগে, ব্যাপক গণ-আন্দোলনের চাপে গ্যানেন্দ্রকে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছিল। এরপর নেপাল একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের পর থেকে অনেক নাগরিক দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্রমাবনতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়েছে।
রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার বাড়তে থাকা জনসমর্থন সত্ত্বেও, জ্ঞানেন্দ্র এখনো নিজের প্রত্যাবর্তনের আহ্বান নিয়ে নীরব রয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তার সিংহাসনে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, প্রজাতন্ত্র এখন সংবিধানে দৃঢ়ভাবে লিপিবদ্ধ, আর মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী।
জ্ঞানেন্দ্র প্রথম সিংহাসনে বসেন ২০০২ সালে, তার ভাই রাজা বিরেন্দ্র এবং পরিবারের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর। শুরুতে তিনি একজন সাংবিধানিক রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। কিন্তু ২০০৫ সালে তিনি একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা দখল করেন - সরকার ও সংসদ ভেঙে দেন, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন, এবং জরুরি অবস্থা জারি করেন।
তার এই স্বৈরাচারী পদক্ষেপই ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দেয়, যা শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রের পতন এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।
Comments