চট্টগ্রামে ‘ভয়ঙ্কর’ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি : ৮ মাসে দ্বিগুণ রোগী, বাড়ছে মৃত্যু

চট্টগ্রামে এ বছর 'ভয়ঙ্কর' রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। মাত্র আট মাসেই রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে গত বছরের তুলনায়। আর মৃত্যুও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। জুলাই ও আগস্টে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ বাড়ছে স্বাস্থ্য বিভাগের। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টে রোগী ছিল ৫৬৬ জন। আর মৃত্যু হয়েছিল ৬ জনের। কিন্তু ২০২৫ সালে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত রোগী সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৪৫ জনে এবং মৃত্যু ১৪ জন। অর্থাৎ রোগী বেড়েছে প্রায় দুই গুণ। আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।
সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক চিত্র জুলাই ও আগস্টে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ডেঙ্গু রোগী ছিল ১৯৮ জন। কিন্তু ২০২৫ সালে বেড়ে হয়েছে ৪৩০ জন। অর্থাৎ বছরের একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১১৭ শতাংশ। মৃত্যুও বেড়েছে সাত গুণ। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে একজন মারা গেলেও এ বছর একই মাসে মারা গেছে ৭ জন। আগস্টের অবস্থাও আরও ভয়াবহ। গত বছরের পুরো আগস্টে রোগী ছিল ২০২ জন আর মৃত্যু ১ জনের। অথচ এ বছরের মাত্র ১৪ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ২৭০ জন। অর্থাৎ, মাত্র অর্ধেক মাসেই গত বছরের পুরো মাসের তুলনায় রোগী বেড়েছে প্রায় ৩৪%। আর মৃত্যু ৫ জন। যা হিসেব করলে ২০২৪ সালের তুলনায় একই সময়ে মৃত্যু বেড়েছে চারগুণ বেশি।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বছরের প্রথম দিকে পরিস্থিতি তুলনামূলক স্থিতিশীল থাকলেও মে থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। মে মাসে রোগী বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ (১৭ থেকে ১১৬), জুনে বেড়েছে তিন গুণের বেশি (৪১ থেকে ১৭৬)।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে এ বছরের পরিস্থিতি ২০২৩ সালের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাই বাড়িঘর ও আশপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানির পাত্র ও টায়ার ফেলে রাখা বন্ধ করা, এবং নিয়মিত ফগিং কার্যক্রম জোরদারের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুর রব বলেন, জুলাই-আগস্টের এই ঊর্ধ্বগতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যথেষ্ট কার্যকর হয়নি। বিশেষ করে বর্ষার শুরুতেই যদি মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যেত, এ পরিস্থিতি কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হতো।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা বৃষ্টিপাত, অপর্যাপ্ত ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়াই সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এখনই জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে সামনে পরিস্থিতি সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. নূর মোহাম্মদ জানান, এ বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৪ জন। আর জুলাইয়ের চেয়ে আগস্টে ডেঙ্গুরোগী বেড়েছে ৫৩ ভাগ। এ ছাড়া জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৪৪ জন। আর এ মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৭৭৮ জন।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব তুলনামূলক আগে শুরু হয়েছে এবং জুলাই-আগস্টে তা বেশি বেড়েছে। আমরা প্রতিদিনের ভিত্তিতে হাসপাতালগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহ করছি এবং সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বাড়ির আশপাশে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা ১শ দিনের বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আমাদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম আছে। মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া অসচেতন বাড়ির মালিকদের ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে জরিমানার আওতায়ও আনা হচ্ছে।
Comments