চোরা শিকারিদের নিষ্ঠুর ফাঁদে বলি হচ্ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

সুন্দরবনের বুকে হরিণ শিকারের নিষ্ঠুরতা দিনদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বন বিভাগের একের পর এক অভিযানে ফাঁদ, জাল, ও পাচারের সরঞ্জাম উদ্ধার হলেও শিকারি চক্রের সদস্যরা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয়দের মতে, এই চক্র এখন এতটাই সংঘবদ্ধ ও কৌশলী হয়ে উঠেছে যে তাদের কার্যক্রম পুরো বনজ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে।
সর্বশেষ সোমবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় পূর্ব সুন্দরবনের কোকিলমনি ও টিয়ারচর এলাকায় বিশেষ অভিযানে হরিণ শিকারে ব্যবহৃত ৬০০টির বেশি মালা ফাঁদ ও কাঁকড়া ধরার ১৬টি নিষিদ্ধ চারু জব্দ করা হয়েছে। বন বিভাগের টহল দল অভিযান চালালেও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বন বিভাগের নিয়মিত টহলের খবর পেয়ে শিকারিরা আগেভাগেই এলাকা ত্যাগ করে। নিজেদের গোপন রাখার কৌশল হিসেবে তারা ফাঁদগুলো মাটির নিচে পুঁতে রাখে। উদ্ধার করা ফাঁদ ও চারু বর্তমানে কোকিলমনি টহল ফাঁড়িতে সংরক্ষণে রাখা হয়েছে।
এ ঘটনার মাত্র তিন দিন আগেই, ১৩ জুন, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ঢাংমারী এলাকায় ১৩৫টি হরিণ শিকারের ফাঁদ উদ্ধার করে বন বিভাগের সদস্যরা। এর মধ্যে হুলার ভারানী সংলগ্ন খাল থেকে ৮২টি এবং সূর্যমুখী খালের আশপাশ থেকে ৫৩টি ফাঁদ জব্দ করা হয়। পরে সব ফাঁদ পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়।
বন বিভাগের অভিযান চলমান থাকলেও হরিণ শিকারি চক্র বারবার আইনের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, এসব শিকারি শুধু জেলেপল্লির কিছু গরিব মানুষ নন, বরং একটি শক্তিশালী চক্র বহুদিন ধরে বনজ প্রাণী পাচারে জড়িত। তাদের পেছনে রয়েছে অর্থ ও প্রভাবের সমর্থন। চক্রটি পরিকল্পিতভাবে বনে ফাঁদ পুঁতে রেখে শিকার করে এবং রাতের অন্ধকারে ট্রলারযোগে হরিণ পাচার করে স্থানীয় বাজারে। শোনা যাচ্ছে, কেজিপ্রতি হরিণের মাংস এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতেও।
পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, হরিণ শিকারের এমন চলমান প্রবণতা যদি দ্রুত বন্ধ না করা যায়, তাহলে সুন্দরবনের খাদ্যচক্রের ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে পড়বে। বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাদ্য তালিকায় প্রধান স্থান দখল করে থাকা চিত্রা হরিণের সংখ্যা কমে গেলে হুমকির মুখে পড়বে পুরো বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা।
বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, "চোরা শিকার রোধে আমরা প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি জোরদার করছি। এছাড়া স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে সচেতনতা বাড়ানোর কাজও চলমান রয়েছে। যারা অপরাধে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে।"
উল্লেখ্য, সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে প্রতিমাসেই বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের কম্বিং অপারেশনের মাধ্যমে শত শত ফাঁদ উদ্ধার করা হচ্ছে। কিছুদিন পরপর উদ্ধার হচ্ছে হরিণের মাংস, শিং, কাটা অংশ। অথচ মূল পরিকল্পনাকারীরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, যা বন ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে।
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থলগুলোর একটি। অথচ এই বনের বুকে প্রতিদিনই চলছে নির্বিচারে শিকার, গাছ কাটা ও প্রাণী পাচারের মতো অপরাধ। প্রয়োজন এখন আর শুধু অভিযান নয়—প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় এবং স্থানীয়দের আন্তরিক অংশগ্রহণ।
Comments