বিজয় দিবসের ভাবনা: বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জরুরি চ্যালেঞ্জ
আজ ৫৫তম বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বিজয়কে ঘিরে দেশজুড়ে উদ্যাপন চলছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রক্ত দিয়ে অর্জিত এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে চিরদিন অম্লান থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল বৈষম্য ও নিপীড়নমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলা। ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে প্রায়ই 'সহনশীলতা ও টিকে থাকার গল্প' হিসেবে তুলে ধরা হয়। দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দীর্ঘদিনের বিদেশি সহায়তা নির্ভরতা কাটিয়ে দেশটি ধীরে ধীরে একটি প্রাণবন্ত নিম্ন-মধ্যম আয়ের অর্থনীতিতে রূপ নিয়েছে। ২০২৬ সালের নভেম্বর মাসে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ, যা কয়েক দশকের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতির স্বীকৃতি। প্রবাসী আয়, রপ্তানিনির্ভর শিল্পায়ন, কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ, ছোট উদ্যোগ এবং শ্রমবাজারে নারীদের বাড়তি অংশগ্রহণ, সব মিলিয়ে দারিদ্র্য হ্রাস ও মানব উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচকে অগ্রগতি এসেছে।
তবে এই সাফল্যের আড়ালেও রয়েছে এক উদ্বেগজনক বাস্তবতা। আজ বাংলাদেশের সামনে মূল প্রশ্ন আর কত দ্রুত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা নয়, বরং কার জন্য এই প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। সাম্প্রতিক দারিদ্র্য বাড়ার প্রবণতা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং একের পর এক সংকট অর্থনীতির গভীর ভঙ্গুরতা প্রমাণ করে জানান দেয় যে, প্রবৃদ্ধি একাই আর যথেষ্ট নয়। আসল চ্যালেঞ্জ হলো এমন প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা, যা হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল এবং সব নাগরিকের জন্য মর্যাদা ও সুযোগ নিশ্চিত করতে সক্ষম।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের ২১ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। স্বাধীন গবেষণায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ বলে উঠে এসেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) বলছে, সামগ্রিক দারিদ্র্যের হার ২৮ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে এবং চরম দারিদ্র্য ৯ শতাংশেরও বেশি। আজও লাখো মানুষ দৈনিক ২৬৫ টাকার কম আয়ে বেঁচে আছে, যা মনে করিয়ে দেয় যে অগ্রগতি কতটা নাজুক ও প্রত্যাবর্তনযোগ্য হতে পারে।
এই পশ্চাদপসরণের পেছনে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক ধাক্কা ভূমিকা রেখেছে। কোভিড-১৯ মহামারি অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবিকা ধ্বংস করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটিয়ে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা ও তাপপ্রবাহ, দেশকে বারবার বিপর্যস্ত করছে। লাগাতার মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে। এসব সংকট একত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার গভীর কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোকে নগ্ন করে দিয়েছে।
টেকসই দারিদ্র্য হ্রাসের পথে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি হলো কর্মসংস্থানের কাঠামো। বাংলাদেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এসব কাজে সাধারণত স্বল্প মজুরি, অনিয়মিত আয়, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক সুরক্ষার অভাব প্রকট। লাখো মানুষের জন্য সামান্য অসুস্থতা, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ বা মূল্যবৃদ্ধিই পুরো পরিবারকে দারিদ্র্যের ফাঁদে ফেলতে পারে। এমন বাস্তবতায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জীবনমানের উন্নয়ন বা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না।
উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে নগরায়ণকে দেখা হলেও, এটি নতুন জটিলতাও তৈরি করেছে। উচ্চ উৎপাদনশীল সেবা ও শিল্পের মাধ্যমে শহরগুলো সম্প্রসারিত হলেও নগর দারিদ্র্য আরও গভীর ও বহুমাত্রিক হচ্ছে। বস্তিবাসী ও স্বল্প আয়ের নগর শ্রমিকরা ভিড়াক্রান্ত বাসস্থান, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন, অনিরাপদ কর্মসংস্থান এবং অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবার মধ্যেই বাস করছে।
নগর-গ্রাম বৈষম্যও স্পষ্ট। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো স্বল্প লাভজনক কৃষি ও অনানুষ্ঠানিক কাজের ওপর নির্ভরশীল, আর শহরগুলো বাজার,প্রযুক্তি ও সেবার ভালো সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক সম্পদ ও ডিজিটাল সংযোগে বৈষম্য এই ব্যবধান আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। দরিদ্র ও গ্রামীণ পরিবারের শিশুরা তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের স্কুলে পড়ে, অপুষ্টিতে ভোগে এবং দ্রুত ঝরে পড়ে। ফলে আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণে তারা প্রস্তুত হতে পারে না। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম দারিদ্র্য বয়ে চলে।
মানব উন্নয়ন, যা একসময় বাংলাদেশের সাফল্যের অন্যতম স্তম্ভ ছিল, তা এখন চাপে পড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে অপুষ্টি উদ্বেগজনকভাবে বেশি। চিকিৎসার ব্যয় বহনের চাপ অনেক পরিবারকে ঋণের বোঝায় ফেলে বা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মানে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে, যা বৈষম্য কমানোর বদলে আরও শক্ত করছে। মানবসম্পদে জরুরি বিনিয়োগ না হলে জনমিতিক লভ্যাংশের সম্ভাবনা উল্টো বোঝায় পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রে থাকতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি। এর জন্য অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের আওতায় সামাজিক সুরক্ষা সম্প্রসারণ, শ্রম অধিকার জোরদার এবং শিল্প বৈচিত্র্য ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি জরুরি। গ্রামীণ উন্নয়নে লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, যাতে বাধ্যতামূলক নয়, বরং সুযোগের খোঁজে মানুষ শহরমুখী হয়। একই সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গভীর সংস্কার দরকার, যাতে কেবল প্রবেশাধিকার নয়,মান ও ন্যায্যতাও নিশ্চিত হয়।
বাংলাদেশের অতীত সাফল্য প্রমাণ করে - রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সামাজিক উদ্ভাবন ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। তবে উন্নয়নের পরবর্তী ধাপ হবে আরও জটিল ও কম সহনশীল। যে প্রবৃদ্ধি লাখো মানুষকে পেছনে ফেলে রাখে,তা শুধু অন্যায়ই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকেও টেকসই নয়। ঐতিহাসিক এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রকৃত মানদণ্ড হবে না শুধু জিডিপির সংখ্যা বা উত্তরণ উদ্যাপন;বরং প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা, মর্যাদা ও আশার সঙ্গে বেঁচে থাকার ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করতে পারাই হবে আসল বিজয়।
Comments