কেন ভূমিকম্প বিমাকে জাতীয় অগ্রাধিকার করতে হবে
সম্প্রতি মাত্র ৩৭ ঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশে চারটি ভূমিকম্প হয়েছে - একটি মধ্যম মাত্রার এবং তিনটি হালকা কম্পন। এই অস্বাভাবিক ভূমিকম্প-ধারা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে এবং আমাদেরকে কঠোরভাবে মনে করিয়ে দিয়েছে যে আমরা বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প অঞ্চলে বসবাস করি। যদিও এসব কম্পনে বড় ধরনের ধ্বংস হয়নি, তবে এগুলো আমাদের সামনে এক গুরুতর প্রশ্ন তুলে ধরেছে - একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের জন্য আমরা কি সত্যিই প্রস্তুত?
বিমা খাতে এক দশকেরও বেশি সময় কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি - ভৌত অবকাঠামো, আর্থিক সক্ষমতা ও সামাজিক মানসিকতার দিক থেকে আমরা এখনো সেই প্রস্তুতির কাছাকাছি নই। দ্রুত নগরায়ণ, বহুতল ভবনের বিস্তার এবং আবাসন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি সত্ত্বেও আমাদের ঘরবাড়ি সুরক্ষায় দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত দুর্বল। দেশের ৯৮ শতাংশেরও বেশি গৃহস্থ ও ফ্ল্যাট-মালিকের কোনো বিমা নেই - অর্থাৎ তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ একেবারেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
এটি শুধু পেশাগত মূল্যায়ন নয় - এটি একজন নাগরিক হিসেবে আমার আন্তরিক আবেদন। আমরা যখন দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এগোচ্ছি, তখন আমাদের একটি প্রস্তুতিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন। আর সেই প্রস্তুতি শুরু হওয়া উচিত আমাদের ঘর থেকেই - যেখানে আমাদের পরিবার নিরাপত্তা, স্বস্তি ও ভবিষ্যতের আশ্রয় খুঁজে পায়।
বাংলাদেশের ভূমিকম্প-ঝুঁকি কোনো তাত্ত্বিক আশঙ্কা নয়। ভারতীয়, ইউরেশীয় ও বার্মিজ তলদেশীয় প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এই দেশ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকম্প অঞ্চলের একটি। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা বহুবার সতর্ক করে বলেছেন - যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। তবুও আমরা অনেকেই আত্মতুষ্টির সঙ্গে ধরে নিই - "আমাদের জীবদ্দশায় বড় ভূমিকম্প হবে না" - যদিও বৈজ্ঞানিক গবেষণা এর উল্টো ইঙ্গিত দেয়।
আমাদের নগরগুলো এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুরসহ প্রায় সব বড় শহরেই বহু পুরোনো বহুতল ভবন রয়েছে- যেগুলো নির্মাণকালে ভূমিকম্প প্রতিরোধের মানদণ্ড হয় ছিল না বা খুব কম জানা ছিল। নতুন ভবনগুলো তুলনামূলকভাবে উন্নত হলেও সংকীর্ণ রাস্তা, জনাকীর্ণ নির্মাণ, মাটি দেবে যাওয়ার ঝুঁকি, কাঠামোগত মূল্যায়নের অভাব, বাসিন্দাদের অননুমোদিত পরিবর্তনসহ অসংখ্য সমস্যা রয়ে গেছে। ফলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও বড় ক্ষতি হতে পারে, আর শক্তিশালী ভূমিকম্প হলে তা হতে পারে নজিরবিহীন বিপর্যয়।
আর্থিকভাবে আমাদের অবস্থা আরও দুর্বল। বাংলাদেশে অধিকাংশ মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হলো তাদের ঘর বা অ্যাপার্টমেন্ট - যা বহু বছরের পরিশ্রমে গড়ে ওঠে। অথচ অন্যান্য দেশে যেখানে গৃহ বিমা বাধ্যতামূলক বা অন্তত ব্যাপকভাবে প্রচলিত, সেখানে বাংলাদেশে এই হার ২ শতাংশেরও কম। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক না হলে মানুষ ঘরবাড়ি বিমা করতে আগ্রহী নয়। অনেকে মনে করেন এটি অপ্রয়োজনীয় বা খুব ব্যয়বহুল - যা পুরোপুরি ভুল ধারণা। বিমা না থাকলে ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনর্গঠনের সম্পূর্ণ খরচ গৃহমালিককে একাই বহন করতে হবে - যার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা বা পুনরুদ্ধার তহবিল নেই।
এই প্রেক্ষাপটে অ-জীবন বিমা কোম্পানিগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এমন বিমা প্রদান করে যা সাময়িক ধাক্কা ও জীবনভর ক্ষতির মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে। ভূমিকম্প বিমা কাঠামোগত ক্ষতি,ভাঙা ফিটিংস,নষ্ট আসবাব ও সামগ্রী, সাময়িক ভাড়ার ব্যয়, এমনকি ধ্বংসাবশেষ অপসারণ পর্যন্ত কাভার করতে পারে। বড় ভূমিকম্পের পর এই সুরক্ষা পরিবারগুলোকে মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে ফিরে দাঁড়াতে সহায়তা করে।
জাতীয় পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রেও বিমা অত্যন্ত অপরিহার্য। কোনো সরকারই - আমাদের বা অন্য দেশের - একটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর সম্পূর্ণ পুনর্নিমানের খরচ বহন করতে পারে না। যেখানে সম্পত্তি বিমাকৃত, সেখানে পুনর্নির্মাণ ব্যয়ের বড় অংশ আসে বিমা খাত থেকে - যা পুনর্গঠন দ্রুত করে, সরকারের ওপর চাপ কমায়, ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত সচল হতে সাহায্য করে এবং মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে বাধা দেয়। জাপান, তুরস্ক, নিউজিল্যান্ড - সব দেশেই এই মডেল কার্যকর প্রমাণ হয়েছে।
বিমা কোম্পানিগুলোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো নিরাপদ নির্মাণকে উৎসাহিত করা। বিমা পেতে হলে ভবনকে নির্দিষ্ট নিরাপত্তা ও প্রকৌশল মানদণ্ড পূরণ করতে হয়। ফলে ডেভেলপাররা মানসম্মত ডিজাইন, ভালো উপকরণ এবং পেশাদার প্রকৌশল পদ্ধতি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। যখন বিমার শর্ত জাতীয় বিল্ডিং কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তখন পুরো রিয়েল এস্টেট খাতই আরও নিরাপদ হয়ে ওঠে।
তবুও তিনটি বড় ভুল ধারণা মানুষকে বাড়ি বীমা করতে বাধা দেয় -
প্রথম ভুল ধারণা- বিমা খুব ব্যয়বহুল। বাস্তবে একটি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টের ভূমিকম্প বিমার বার্ষিক প্রিমিয়াম অনেক সময় একটি পরিবারের একদিনের রেস্তোরাঁর ডিনারের চেয়েও কম। ঘরের মূল্য যেখানে ৫০ লাখ থেকে কয়েক কোটি টাকা - তার তুলনায় বিমা খরচ প্রায় তুচ্ছ।
দ্বিতীয় ভুল ধারণা - "আমার ভবন কিছু হবে না।" দুর্ভাগ্যজনকভাবে আশাবাদ কাঠামোকে রক্ষা করে না। মাটি, ডিজাইন এবং ভূমিকম্পের তীব্রতার উপর নির্ভর করে যেকোনো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তৃতীয় ভুল ধারণা - বিমা কোম্পানি নাকি দাবি মেটায় না। গ্রিন ডেল্টার মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদা স্বচ্ছ ও সময়মতো দাবি নিষ্পত্তির জন্য পরিচিত। কাভারেজ সক্রিয় থাকলে, ভবন সঠিকভাবে ঘোষিত হলে এবং ক্ষতি বাস্তব হলে দাবি অবশ্যই পরিশোধ করা হয়। আমরা স্বতন্ত্র সার্ভেয়র, কাঠামো প্রকৌশলী এবং আন্তর্জাতিক পুনর্বীমাকারীদের সঙ্গে কাজ করি যাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।
আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে গৃহ বিমার গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। একটি বাড়ি শুধু ইট-সিমেন্টের কাঠামো নয় - এটি একটি পরিবারের সারাজীবনের স্বপ্ন ও শ্রমের প্রতিফলন। তবুও বহু পরিবার এই অপরিমেয় সম্পদকে সুরক্ষাহীন রাখে। অন্যান্য দুর্যোগের মতো ভূমিকম্প আগাম প্রস্তুতির সুযোগ দেয় না - এক মুহূর্তেই বড় ক্ষতি হতে পারে। সামান্য ফাটল মেরামতে লাখ টাকা খরচ হতে পারে, আর বড় ক্ষতিতে পুরো ভবন পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন হতে পারে। বিমা না থাকলে এই বিপুল আর্থিক বোঝা গৃহমালিককে একাই বয়ে বেড়াতে হবে। ব্যাংক তো কিস্তি নেবে - ভবন বসবাসের অযোগ্য হলেও। ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষিত থাকে; গৃহমালিকের সঞ্চয় থাকে না - যদি না বিমা থাকে।
বাড়ির বিমা করলে পরিবার শুধু নিজেদের নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ভূমিকম্প বিমা কোনো বিলাসিতা নয় - এটি দায়িত্বশীল, অপরিহার্য এক সুরক্ষা।
আমাদের সমাজ হিসেবে নিরাপত্তা-অগ্রাধিকারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা জরুরি। ভূমিকম্প দূরের সম্ভাবনা নয়; এটি পুনরাবৃত্ত, হঠাৎ ও অনিশ্চিত বাস্তবতা। দুর্যোগের পর শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না - নিজেদের সম্পদ ও পরিবারকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদেরই।
বাংলাদেশ দ্রুত এগোচ্ছে। আমাদের নগরায়ণ, বিনিয়োগ, আর্থিক উন্নয়ন -সবই প্রশংসনীয়। কিন্তু সুরক্ষা ছাড়া উন্নয়ন ভঙুর। একটি বড় ভূমিকম্প মুহূর্তে বহু বছরের অগ্রগতি ধ্বংস করে দিতে পারে -যদি এখনই প্রস্তুতি না নেই।
বিমা খাতে কাজ করার সৌভাগ্য নিয়ে আমি প্রতিটি নাগরিকের প্রতি আন্তরিক আবেদন জানাই -আপনার বাড়িকে সুরক্ষিত করুন, আপনার পরিবারকে সুরক্ষিত করুন, আপনার ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করুন।
সাম্প্রতিক কম্পনগুলো হোক আমাদের জন্য একটি জাগরণের বার্তা - কোনো ট্র্যাজেডির পূর্বাভাস নয়। এখনই উদ্যোগ নেওয়ার সময়।
লেখক : ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও হেড অব ক্লাস্টার বিজনেস, গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি পিএলসি
Comments