সংকটে অর্থনীতি, স্বস্তির খোঁজে ক্লান্ত মানুষ
বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ ঠিক একটি ক্লান্ত পথিকের মতো - যে বহুদূর হেঁটে এসে হঠাৎ থমকে গেছে। পথের দিক সে জানে, কিন্তু পা দুটো সামনে বাড়ে না। তার মাথার ওপর জ্বলছে মূল্যস্ফীতির রোদ, পেছন থেকে আঘাত করছে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার বাতাস। আর সামনে? সামনে কেবলই কুয়াশা।
অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.১৭ শতাংশ, যা -দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। ভারত, যার অর্থনীতি বহুস্তর বিশিষ্ট, বিশাল জনগোষ্ঠীর বোঝা বহন করে, তারা রাখতে পেরেছে ০.২৫ শতাংশে। অথচ আমরা পারিনি। শ্রীলঙ্কা কয়দিন আগেও দেউলিয়া রাষ্ট্রটি, মূল্যস্ফীতি নামিয়ে এনেছে ২.১ শতাংশে।
তুলনাটি অস্বস্তিকর, এমনকি লজ্জাজনকও বটে। কিন্তু এ লজ্জা শুধু অর্থনীতির নয়; এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার লজ্জা, নীতিনির্ধারণের অসামঞ্জস্যের লজ্জা।
ব্যাংক হচ্ছে সরকারের টানাটানি মাঠ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় সরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৬১ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৭.২২ শতাংশ। অর্থাৎ সরকার ব্যাংক ব্যবস্থাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে। এর বিপরীতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি কমে ৬.২৯ শতাংশে নেমে গেছে। এই অমিলটি শুধু সংখ্যা নয় - এটি অর্থনীতির ওপর রাজনৈতিক চাপের প্রতিচ্ছবি।
রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরার পরিবর্তে সরকার এখন টাকাভিত্তিক সমাধানে ঝুঁকছে। ফলে ব্যাংকের টাকা সরকারের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে,উদ্যোক্তাদের দিকে নয়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথে এটি সরাসরি থামার সংকেত।
ব্যবসায়ীর ভাষায় বললে -"টাকা নেই, তাই উদ্যোগ নেই। উদ্যোগ নেই, তাই কর্মসংস্থান নেই।" আর সাধারণ মানুষের ভাষায় -"দাম বাড়ছে, আয় বাড়ছে না।" অর্থনীতির ওপর সবচেয়ে বড় অদৃশ্য কর হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সেটাই ঘটছে। মব সংস্কৃতির বিকাশে বাঙালি সংস্কৃতি লুপ্ত প্রায় আর এর কারণে দেশের অর্থনীতির উপর আস্থা রাখতে পারছেন না দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
যখন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দিকরেখা স্পষ্ট নয়; যখন বলা যায় না আগামী ছয় মাসে নীতি কোনদিকে মোড় নেবে; যখন সড়ক থেকে সংসদ পর্যন্ত উত্তাপ বাড়তে থাকে - তখন অর্থনীতি নিঃশব্দে ধীরে ধীরে জমে যায়।
এই অনিশ্চয়তার মুহূর্তে কোনো উদ্যোক্তা তাঁর সঞ্চয় কারখানায় ঢালবেন না। কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করবে না। ব্যাংকও তার ঋণ দেওয়ার মানদণ্ড কঠোর করে। ফলে অর্থনীতির আস্থা ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশ আজ ঠিক সেই আস্থাহীনতার গহ্বরে দাঁড়িয়ে।
দেশে মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতের দুর্দশা, উচ্চ সুদহার- এসব অনেকদিন ধরেই আছে। এর ওপর যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের টানাপোড়েন। যেন অর্থনীতির বুকে একটি নতুন বোঝা চাপানো হয়েছে।
মানুষের জীবন তো সংখ্যার চেয়ে বড় সত্য। ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি -এটি পরিসংখ্যানবিদের টেবিলে একটি সংখ্যা। কিন্তু বাস্তব জীবনে এটি মধ্যবিত্তের নিত্যসংগ্রাম। তাকে বাজারে গিয়ে আজ ব্যাগভর্তি নয়, হাতে সদাই নিয়ে ফিরতে হয়, বাচ্চার দুধের কৌটা কেনার আগে হিসাব মিলাতে হয়। মাসের শেষে বিদ্যুৎ বিল দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়।
রোজগার যে বাড়ছে কম, তা জানার জন্য কোনো অর্থনৈতিক সূচক দরকার হয় না। মানুষের হাঁটার ভঙ্গি, মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এই ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস বাজারে চাহিদা কমিয়ে দেয়; চাহিদা কমলে ব্যবসা ধীর হয়; ব্যবসা ধীর হলে কর্মসংস্থান থেমে যায় - এটি অর্থনীতির কঠিন চক্র। আজ আমরা সেই চক্রে বন্দী।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট অর্থনীতির ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক আস্থা, শাসনব্যবস্থার স্থিতি এবং নীতি-সামঞ্জস্যের অভাব। অর্থনৈতিক সমাধান তাই রাজনৈতিক স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে শুরু করতে হবে।
সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরানো জরুরি কাজ। বিনিয়োগকারীর প্রথম চাহিদা হচ্ছে স্থিতিশীল পরিবেশ। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটছাঁট - সরকার চাইলে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব নয়। বেসরকারি খাতকে আবার কেন্দ্রস্থলে আনা, কারন বৃদ্ধির একমাত্র পথ এটাই। ব্যাংকিং খাতে শুদ্ধি অভিযান দরকার এবং সে জন্য ঋণখেলাপির রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। জ্বালানি খাতে সুশাসন আনতে পারলে অস্থিতিশীলতা কমলে উৎপাদন খরচও কমে।
অর্থনীতি কখনো একা দাঁড়াতে পারে না। এটি রাজনীতির ছায়া পায়, নীতিনির্ধারণের আশ্বাস পায়, এবং মানুষের আস্থা থেকে শক্তি পায়। আস্থার এই বাতাস না থাকলে উন্নয়নের গাছ ফুল ফলায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটি সন্ধিক্ষণে, যেখানে সামান্য ভুলও বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে সামান্য সঠিক সিদ্ধান্তও বড় পরিবর্তনের পথ খুলতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে-আমরা কোনদিকে হাঁটতে চাই?
Comments