দুর্যোগের পর সাংবাদিকতা: আতঙ্ক নয়, তথ্য দেওয়ার দায়িত্ব
শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়মমাফিক সক্রিয় থেকেছে। ঘটনাস্থল কভার করা, হাসপাতাল থেকে রিপোর্টিং করা, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব দেওয়া, সরকারি ভাষ্য প্রচার করা এবং বিশেষজ্ঞ মতামত প্রচার করা – সবই ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন জেগেছে স্পেকুলেশন বা অনুমান নির্ভর তথ্য দিতে গিয়ে। কোন কোন সংবাদপত্র ও টেলিভিশন, অনলাইন মানুষকে সতর্ক করতে গিয়ে আতংক ছড়িয়েছে কিনা সেটা ভাববার সময় এসেছে। এত মাত্রায় বা অত মাত্রায় ভূমিকম্প হলে লাখ লাখ বিল্ডিং ধসে পড়বে, লাখো মানুষ মারা যাবে – জাতীয় তথ্য কি মানুষকে সচতেন করল না ভয় ধরিয়ে দিল সেটা নিয়ে ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ, আতংক তৈরি করা সাংবাদিকের কাজ নয়।
দুর্যোগ – সেটা প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট যাই হোক না কেন - ঘটনার ঠিক পর মুহূর্তেই মানুষ ভরসা করে সাংবাদিকদের ওপর। তারা চায় নির্ভরযোগ্য তথ্য,পরিস্থিতি বোঝার উপায় এবং দিকনির্দেশনা। এমন সংকটময় সময়ে সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা থাকে না; এটি সত্যের প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতা হয়ে ওঠে। বিল কোভাচ ও টম রোজেনস্টিয়েলের ভাষায়,"সাংবাদিকতার প্রথম দায়িত্ব সত্যের প্রতি।" ভয় ও অনিশ্চয়তা যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে, তখন এই নীতিই হয়ে ওঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা হলো আতঙ্ক বাড়ানো নয়, বরং সঠিক,প্রাসঙ্গিক এবং নির্ভুল তথ্য দিয়ে জনগণের উপকার করা।
কিন্তু বাস্তবে দুর্যোগের সময় আকর্ষণীয়তার প্রতিযোগিতা অনেক সময় সাংবাদিকতাকে সেনসেশনালিজমের দিকে ঠেলে দেয়। নাটকীয় চিত্র, অতিরঞ্জিত ভাষা ও যাচাইবিহীন তথ্য হয়তো দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কিন্তু তা বাস্তবতাকে বিকৃত করে এবং মানুষের উদ্বেগ বাড়ায়।
সব সময়ই সতর্ক করা হয় যে, "খারাপ সাংবাদিকতা অনৈতিক"। মানবিক বিপর্যয়কে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা শুধু নৈতিকতার বিরোধী নয়, এটি মানুষের বিশ্বাসকেও বিপন্ন করে তোলে - যে মুহূর্তে সেই বিশ্বাসের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা তাই এই প্রলোভনকে প্রতিরোধ করে, এবং নাটক নয়, বরং বিশ্বাসযোগ্য ও দায়িত্বশীল তথ্য পরিবেশনে মনোযোগ দেয়।
যাচাই বা ভেরিফিকেশন দুর্যোগ-পরবর্তী সাংবাদিকতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। বিশেষ করে যখন গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সত্যের আগেই ছড়িয়ে পড়ে, তখন সাংবাদিকদের আরও সতর্ক হতে হয়, প্রকাশের আগে তথ্য ও ছবি নিশ্চিত করা অপরিহার্য। গতকাল অনেক গণমাধ্যমই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এআই জেনারেটেড ছবি ও ভিজুয়াল ব্যবহার করেছে, বুঝতে পেরে আবার সরিয়েও নিয়েছে। এখানে দায়িত্ববোধের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এবং সেটা মোকাবেলায় সতর্ক থাকা হয়নি। ডিজিটাল যুগে ছবি সম্পাদনা, শব্দ কাটাছাঁট, এআই-জেনারেটেড ভিজ্যুয়াল -সব সহজ হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিকতার মানদণ্ড একই আছে - যা সত্য নয়,তা ব্যবহার নয়। এআই-তৈরি ছবি বা অডিও হলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। দর্শককে বিভ্রান্ত করা মানে দায়িত্বহীনতা।
একটি ছবি হাজার শব্দের সমান - এ কথা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি এর অপব্যবহার হাজার ভুলকে বৈধ করে তুলতে পারে। বিকৃত ছবি, কনটেক্সট ছাড়া ফ্রেম, বানানো বা পুরোনো ছবি ব্যবহার করে নতুন তথ্যের সঙ্গে যুক্ত করা - সবই সাংবাদিকতার নৈতিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। দুর্যোগ, সহিংসতা বা কোনো ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি ব্যবহারে মানবিকতা ও সম্মতির গুরুত্ব অপরিসীম।
আধুনিক সাংবাদিকতার অন্যতম তাত্ত্বিক ওয়াল্টার লিপম্যান বলেছেন, "সত্য বলা এবং অসত্যকে লজ্জিত করা -এর চেয়ে বড় আইন সাংবাদিকতায় নেই।" সাংবাদিকরা যখন এই নীতিতে অটল থাকেন, তখন তারা অকারণ আতঙ্ক ঠেকাতে পারেন এবং জনগণকে জ্ঞানসমৃদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন। স্থাপনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কি এছাড়া ভাষা ও উপস্থাপনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য পরিবেশনের ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা, মানবিকতা এবং মর্মাহত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা জরুরি। সেনসেশনালিজম মানুষকে অবমাননা করে; আর চিন্তাশীল সাংবাদিকতা তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে আনে। এডওয়ার্ড আর. মারো একবার বলেছিলেন, "বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে আমাদের সত্যবাদী হতে হবে; সত্যবাদী হতে হলে আমাদের বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। " দুর্যোগের পর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন হয় নাটক দিয়ে নয়, বরং সংযত ভাষা, যাচাই করা তথ্য এবং সহানুভূতিশীল গল্প বলার মাধ্যমে। ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ শুধু পরিস্থিতির ভয়াবহতাই প্রকাশ করে না,বরং সহায়তা কার্যক্রম, পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের কথাও তুলে ধরে।
শব্দের ওজন বা শব্দের দায় বুঝতে হয়। শব্দকে নিরপেক্ষ মনে করা হয়,কিন্তু সাংবাদিকতার পরিসরে শব্দই সত্যকে পাল্টে দিতে পারে। একটি বিশেষণ কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ঘটনার পরিচয়কে স্থায়ী দাগ দিয়ে যায়। সংবাদে শব্দ হতে হবে সংযত, নির্ভুল, বস্তুনিষ্ঠ -কোনো পক্ষের প্রতি ঝোঁক নয়। দুর্যোগের রিপোর্টিং-এ যদি লেখা হয় এত বড় ঘটনা আগে কখনও দেখেনি মানুষ – তাহলে তার যথার্থতা নিয়ে ভাবা দরকার।
সবশেষে, দুর্যোগের পর সাংবাদিকতার ভূমিকা হওয়া উচিত স্থিতিশীলতা তৈরি করা। মানুষকে সাহায্য করা - কি ঘটেছে বোঝাতে, ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে, প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে এবং মানসিকভাবে পুনরুদ্ধার হতে। সাংবাদিকরা যখন সত্য, স্বচ্ছতা এবং মানবিকতার ওপর গুরুত্ব দেন, তখন তারা তাদের পেশার সর্বোচ্চ আদর্শকে ধারণ করেন। ক্রিস্টিয়ান অ্যামানপোরের ভাষায়, "আমাদের কাজ হলো সাক্ষ্য দেওয়া," কিন্তু সাক্ষ্য দেওয়া মানে ভয় ছড়ানো নয়। এর অর্থ সত্যকে পূর্ণতা ও সততার সঙ্গে তুলে ধরা - জনসেবার মনোভাব নিয়ে।
সংকটের সময়ে মানুষের প্রয়োজন আতঙ্ক নয় - তথ্য। প্রয়োজন এমন প্রতিবেদন যা তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখে, তাদের শক্তি বাড়ায় এবং সত্যের প্রতি সাংবাদিকতার অপরিহার্য দায়বদ্ধতাকে রক্ষা করে। সংবেদনশীলতার বদলে সংযম, নাটকীয়তার বদলে নির্ভুলতা বেছে নিয়ে সাংবাদিকতা শুধু দুর্যোগের ইতিহাস রচনা করে না - মানুষকে পুনরুদ্ধারের পথও দেখায়।
Comments