শিল্পে পিছিয়ে পড়া শুভ লক্ষণ নয়
দেশে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সেবা খাতের তুলনায় উৎপাদন খাত পিছিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান কম হচ্ছে, সাধারণ ব্যবসা বাণিজ্য বেশি হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক শুমারির প্রাথমিক ফলাফলে এতথ্য পাওয়া গেছে।
শিল্প খাতের প্রসার কমে যাওয়ায় কর্মসংস্থান কম হচ্ছে। অর্থনীতির সাধারণ তত্ত্বই বলে যে, শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি হয়। অর্থনীতির আকার বাড়াতেও এই খাতের ভূমিকা বেশি।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো উদ্যোক্তা তৈরি করতে পারছে না। উদ্যোক্তা হতে চান অনেকেই। কিন্তু যারা হয়েছেন সেই উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই মূলধন সমস্যায় রয়েছেন। আবার যাদের মূলধন নেই, তারা সহজে ঋণও পান না। এমন একটা চক্রের মধ্যে অর্থনীতিতে সেবাখাতই শিল্প খাতকে পিছনে ফেলে অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্রে এগিয়ে রয়েছে। উৎপাদন খাতে বিনিয়োগের অভাব এবং আমদানির ওপর বাড়তি নির্ভরতা এর অন্যতম কারণ। প্রতি বছর ২০ লাখেরও বেশি মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু শিল্প খাতের অবস্থা শোচনীয় বিধায় স্থায়ী কর্ম সংস্থান কম হচ্ছে।
শিল্পের জন্য অনুকূল অবকাঠামো, অনুকূল আইন-কানুন, অনুকূল প্রশাসনিক নীতি এবং অনুকূল ব্যবস্থাপনা রয়েছে কতটা, তা বিচার করেই বিনিয়োগ করেন উদ্যোক্তারা। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্ম সংস্থান এবং রপ্তানি বাণিজ্যের গতি যে মন্থর সেটা মেনে নিয়েই আমাদের সরকারি কর্তারা সুযোগ পেলে বিদেশিদের আহবান করেন বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা দেশের ভাবমূর্তিকে কখনোই শিল্প বান্ধব করে তুলতে পারিনি।
অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বড় অঙ্কের বিনিয়োগ খুব জরুরি। বিনিয়োগ জরুরি কর্মসংস্থানের জন্যও। কৃষি আমাদের অগ্রাধিকার, নাকি শিল্প, এ নিয়ে বিতর্ক এখনও চলমান। কিন্তু একটা কথা তো ঠিক যে কৃষিতে যে বিশাল সাফল্য তা ম্লান হয়ে গেছে কৃষক তার পণ্যের ঠিক দাম না পাওয়ায়। কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ার কোন কার্যকরী উদ্যোগ কখনোই দেখা যায়নি সেভাবে।
আমাদের দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন শিল্প টিকে আছে তৈরি পোশাক খাতের ওপর। রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসে এখান থেকে। পোশাক খাতের বাইরে যে যে অতি ক্ষুদ্র উচ্চ উৎপাদনশীল খাত সমূহ আছে, সেগুলোর প্রসার ঘটানো অগ্রাধিকার হওয়া প্রয়োজন। এর ফলে যেমন এক দিকে বেশি মূল্য সংযোজিত রফতানি বাড়বে, তেমনই অন্য দিকে সার্বিক ভাবে গুণগত মান সম্পন্ন কর্মসংস্থান হবে।
প্রশ্ন হল, কী করলে উৎপাদনশীল ক্ষেত্রটির প্রসার ঘটতে পারে? উচ্চ উৎপাদনশীল শিল্পের প্রসার ঘটানোর জন্য অবশ্যই রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, প্রশাসনিক দ্রুতি, উন্নত পুঁজির বাজার ইত্যাদি আরও কিছু কিছু কাঠামো দরকার। কিন্তু সবার আগে দরকার মানবসম্পদ এবং সেই সম্পদ বৃদ্ধির জন্য উচ্চ এবং মাঝারি পর্যায়ের শিক্ষার প্রসার, যেটা কাম্য হারে ঘটেনি। আমাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ ভাগের বেশি। এটি আমাদের বিপুল সুবিধা বলে দেশেবিদেশে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু এই বিরাট সংখ্যক অল্পবয়সি ছেলেমেয়েকে ঠিক মতো শিক্ষিত করে মানব সম্পদে পরিণত করতে না পারলে তাদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান করা যাবে না। তখন সেই বিপুল সম্পদ একটা মস্ত বোঝায় পরিণত হবে।
সেবা খাতের বিপরীতে উৎপাদন খাতের এ পতন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। শ্রমঘন অর্থনীতিতে উৎপাদন খাতের সম্প্রসারণ না হওয়ায় মূল্য সংযোজন সীমিত হচ্ছে এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে। উৎপাদন বৃদ্ধির প্রধান বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো, জ্বালানি সংকট, অসামঞ্জস্যপূর্ণ রাজস্ব নীতি ও ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন। উৎপাদন খাতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে কর ও রাজস্ব নীতিগুলো প্রতি বছর বদলে যায়। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় থাকেন।
শিল্পের নদীগুলো সব শুকিয়ে যাচ্ছে। সুশীতল, স্বচ্ছ, অফুরান জলের স্রোতকে পুনর্বার আবাহন করতে হবে, পথ দেখাতে হবে। ফ্যাসিবাদ উত্তর বাংলাদেশ এখন সে দিকেই তাকিয়ে।
Comments