বোমার ভয়ের চেয়েও ক্ষুধায় কাতর ফিলিস্তিনিরা

'আমার নিজের সামান্য খাবার থেকে প্রায়ই আমার ছেলেকে ভাগ দিতে হয়, এই ক্ষুধাতেই আমি মারা যাবো—ধীরে ধীরে আমাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।' বলছিলেন ৪৪ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিকমাত আল মাসরি।
উপত্যকাটির শিশুরা গড়ে দিনে একবারেরও কম খাবার পাচ্ছে। দেখা যায়, বাবা-মা নিজের খাবারটুকু তুলে দিচ্ছেন সন্তানের মুখে। নিজেরা থাকছেন অভুক্ত। অনেক সময় সন্তানের মুখে তুলে দেওয়ার খাবারটুকুও পান না তারা। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এমন খবর দিয়েছে।
ইসরায়েলের বোমার চেয়ে ক্ষুধায় বেশি কাতর ফিলিস্তিনিরা। গত সাত সপ্তাহ ধরে গাজা উপত্যকায় খাদ্যসহ সব ধরনের মানবিক সহায়তার প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে গাজাবাসীর দুর্ভোগ চরম সীমায় পৌঁছেছে। হিকমাত বলেন, 'আমাদের দুঃখ দুর্দশার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না, মৃত্যু আমাদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে।'
গত ২ মার্চ গাজা উপত্যকায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এতে গাজাবাসীর জীবন অবর্ণনীয় কষ্ট ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা, চিকিৎসাকর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা।
একদিকে ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণ, অন্যদিকে গাজার মানুষের কাছে না আছে খাবার, না পানি, না বিদ্যুৎ—জেনারেটরও শেষের পথে। অন্ধকারের অতলে পতিত হতে যাচ্ছে লাখ লাখ অসহায় মানুষ।
মানবিক সহায়তা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এবারের সংকট সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মত দিয়েছেন অনেকে।
এরই মধ্যে অসহায় ফিলিস্তিনিদের প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে হচ্ছে এখান থেকে সেখানে। যদিও কোথাও তাদের নিরাপত্তা নেই। হাসপাতালের মতো বেসামরিক স্থাপনায় আবারও হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলের সেনারা। এদিকে খাদ্য, জেনারেটরের জ্বালানি, চিকিৎসা সরঞ্জাম সবই শেষের পথে। নতুন করে কিছু প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল।
গত ১৮ মার্চ একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গাজার ওপর পুনরায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। হামাসের কাছে থাকা অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি না দিলে গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে বারবার জানিয়ে আসছে ইসরায়েলের অনেক রাজনীতিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা।
ইসরায়েলের দাবি, নিরাপত্তার স্বার্থে গাজায় এই অবরোধ দিয়েছেন তারা, ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছেনা। যেটি একটি যুদ্ধাপরাধ।
আট সপ্তাহ হতে চলেছে গাজায় এই অবরোধ জারি রেখেছে নেতানিয়াহু প্রশাসন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থন থাকায় তেমন কোনো আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়াই এই অবরোধ বহাল রাখতে পারবে বলে আত্মবিশ্বাসী নেতানিয়াহু।
এদিকে গাজায় দীর্ঘমেয়াদে সেনাদের উপস্থিতি বজায় রাখা এবং ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে তাদের নিজভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার আশঙ্কাও তীব্র হচ্ছে।
গাজায় নিরাপত্তা বাফার জোন তৈরির নামে মূলত ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে উপত্যকাটির ভূমি দখল করার পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল— এমনই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর ব্যাপারটিও সেনাবাহিনী ও বেসরকারি ঠিকাদারদের হাতে হস্তান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে ইসরায়েলের।
এতে গাজায় সংকট আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিরা এখন ইসরায়েলের বিমান হামলার চেয়ে বেশি দুর্ভিক্ষকে ভয় পাচ্ছেন।
যু্দ্ধবিরতির সময় যে খাদ্য সহায়তা এসেছিল তা প্রায় শেষ। উদভ্রান্তের মতো ত্রাণ দেওয়া তাঁবুগুলোতে খালি হাঁড়ি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন গাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্যমতে, যুদ্ধের সময় বাজারগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এক হাজার ৪০০ শতাংশ।
অক্সফামের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে এক বেলারও কম খাবার পায়। যদিও নতুন করে ইসরায়েলের আদেশে পায় ৪ লাখ ২০ হাজার বাসিন্দাকে সরে যেতে হচ্ছে অন্য আশ্রয়ের খোঁজে তাই সঠিক পাওয়াটা মুশকিল ছিল।
গাজার দেইর আল বালাহর চিকিৎসাকর্মী আমান্দে বাজেরোল জানান, উত্তর গাজা থেকে ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে ফিলিস্তিনিরা এই শহরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ রাস্তায়, কেউবা ভাঙা বাড়িগুলোর মধ্যে তাঁবু টানিয়ে থাকছেন; যা যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। তিনি বলেন, 'এত মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার মতো জায়গা আমাদের নেই। বার্ন ক্লিনিকগুলোতে ১০টার মধ্যেই রোগীর ভর্তি নেওয়া বন্ধ করতে হয়। কারণ আমরা ঔষধের মজুত যত বেশিদিন সম্ভব টিকিয়ে রাখতে চাইছি।'
উত্তর গাজা ও দক্ষিণ গাজা রাফায় ব্যাপকভাবে অভিযান চালিয়ে বর্তমানে উপত্যকাটিতে পার্শ্ববর্তী মিসর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ফিলিস্তিনের প্রায় ৭০ শতাংশ ভূমিই এখন ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে।
মানবাধিকার ও ত্রাণকর্মীরা বলছেন, তাদের কাজ করার পরিধি ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে চলেছে। এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে খান ইউনিসের আল নাসের হাসপাতাল ও গাজা শহরের আল-আহলি হাসপাতালে হামলার ঘটনা উল্লেখ করে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে হাসপাতালে ওই হামলা চালিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ত্রাণকর্মী বলেন, 'গাজার বাসিন্দারা আমাদের আশেপাশে থাকতে চায়। তাদের ধারণা, আমরা সঙ্গে থাকলে আইডিএফ কম হামলা চালাবে তাদের ওপর।'
তিনি বলেন, 'শুরুর দিকে আমাদের দুই কিলোমিটার দূরত্বে হামলা চালানো হতো। ফলে আমরা সরে যেতে পারতাম। ধীরে ধীরে সেটি ৩০০ মিটারে নেমে আসে, এখন তো ৩০ মিটারে চলে এসেছে। একদম পাশেই হামলা চালানো হয়।'
ওই ত্রাণকর্মী আরও বলেন, 'কখনো কখনো সরে যাওয়ার জন্য ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়, যা অসুস্থ রোগীদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়। আমাদের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে।'
এ প্রসঙ্গে আইডিএফ জানায়, হামাস ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিজেদের কার্যক্রম চালায়। আর বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েই তারা সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায়, যেটি আন্তর্জাতিক আইন মেনেই করা হয়।
তাদের অভিযোগ, গাজাতে যে খাদ্য সহায়তা পৌঁছায় তার বড় একটি অংশ আত্মসাৎ করে হামাস। নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার পাশাপাশি বেসামরিক বাসিন্দাদের কাছে চড়াদামে এগুলো বিক্রি করতে তারা এই কাজ করে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সরিয়ে বেসরকারি ঠিকাদারদের দিয়ে গাজায় ত্রান পাঠাবে ইসরায়েল। তবে কবে নাগাদ এই কার্যক্রম শুরু হবে তার কোনো সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি।
এদিকে, শিগগিররই গাজায় মানবিক সহায়তা না পাঠানো হলে তীব্র মানবিক সংকট তৈরি হবে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে।
এরই মধ্যে আরেকটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে মধ্যস্ততাকারী দেশগুলো। তবে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ কিংবা ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারের মতো মৌলিক বিষয়ে মতপার্থক্য থাকায় কোনো পক্ষই ছাড় দিতে রাজি নয়। তাই যুদ্ধবিরতি কার্যকরের সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে উঠেছে।
ইউএনবি
Comments