বাঁচতে হলে জানতে হবে- অনুভূতির ইঞ্জিনিয়ারিং, পর্ব-৪
১১। অদৃশ্য কারাগার (ISOLATION)
'আমার বয়ফ্রেন্ড কিন্তু আমাকে কোন ছেলে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে দেয় না। এমনকি বান্ধবীদের সাথেও বেশি কথা বলে রাগ করে'।
'দেখ বন্ধুদের সাথে বেশি আড্ডা দিলে বউ রাগ করে'।
এই ডায়লগ গুলো কি পরিচিত লাগছে আপনার কাছে?
পরিচিত লাগার কথায় কারণ এই রকম কথা আশেপাশের বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক শুনেছেন, তাই না? এই টেকনিকটার নাম হচ্ছে আইসোলেশন। এই ক্ষেত্রে যেটা করা হয় তা হলো পার্টনারকে তার বন্ধুদের কাছ থেকে এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে মোটামুটি বিচ্ছিন্ন করে একা বানিয়ে দেয়া হয়। মানুষ কিন্তু তার আশেপাশের পরিচিত মানুষদের কাছ থেকে বিভিন্ন আইডিয়া পায় এবং শক্তি নেয়। সবার সাথে মিশে কথা বলে গল্প করে তার চরিত্র গঠন হয় এবং যে কোন বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তাভাবনার একটা অবয়ব গড়ে ওঠে। যখন তাকে একা করে দেওয়া হয় মানে সবার মাঝে থেকেও কারো সাথে কমিউনিকেশন খোলাখুলি করতে দেওয়া হয় না তখন তার মনোজগতে প্রবেশ করা খুব সহজ হয়ে যায়। তার উপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার সহজ হয়। সুতরাং এই টেকনিকের ক্ষেত্রে ম্যানিপুলেটর ভিকটিমকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অন্য মানুষদের থেকে তাকে যতটা সম্ভব আলাদা করে রাখে।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে কি করা উচিত? প্রথমে চিন্তা করা উচিত আপনার জীবনধারা এবং সংস্কৃতির সাথে মানানসই যতটুকু বাইরে যোগাযোগ থাকার কথা ততটুকু আপনার আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে আপনি আইসোলেশনের শিকার। নিজের অধিকার এর কথা ব্যক্ত করুন, খোলাখুলি ভাবে অন্যান্য মানুষদের সাথে যোগাযোগ আপনার প্রাত্যহিক জীবনে কি কি সুবিধা বয়ে আনবে সেই ব্যাপারে কথা বলুন। আইসোলেশন মানুষকে দুর্বল করে ফেলে সুতরাং এর শিকার মানুষদের এ ধরনের কথা বলার সাহস হয় না। ধীরে ধীরে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলুন যুদ্ধ করার জন্য। এই ম্যানিপুলেশন ভেঙে বের হওয়া বেশ কঠিন। দরকার হলে আশেপাশের সাহায্য নিন।
১২। দুর্বল বিষয়ে আঘাত (Exploiting insecurities)
মনে করুন আপনার একটা ঘাটতি আছে যে ব্যাপারে আপনি ওয়াকিবহাল। ধরুন আপনার পার্টনারের সেই ঘাটতি নেই বরং সেই ব্যাপারে সে যথেষ্ট শক্তিশালী। মনে করুন সে খুব ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করেছে কিন্তু আপনি করেননি। এজন্য সে সুযোগ পেলেই আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে। অথবা আপনি অতটা লম্বা নন, প্রায়ই আপনাকে এটা নিয়ে সে খোঁচা দেয়। আপনি দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী নন বা গায়ের রং যথেষ্ট পরিষ্কার নয়, এগুলো নিয়ে এমনভাবে কথা বলে আপনার সাথে যার প্রতিবাদ করার মত কোন যুক্তি আপনার কাছে থাকে না। এটাই হচ্ছে দুর্বল বিষয়ে আঘাত করে আপনার ইনসিকিউরিটি থেকে ফায়দা নেওয়া।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে কি করবেন? আপনাকে নিজের অবস্থানে, নিজের সত্তায় বা নিজের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে হবে। সাথে সাথে এটাও জানিয়ে দিতে হবে যে আপনার সীমাবদ্ধতা আপনার জীবনের একটা সত্য এবং সেটা নিয়েই আপনি এগিয়ে যাবেন জীবনে। কাউকে যদি আপনার সাথে কাজ করতে হয় বা আপনার সাথে জীবন যাপন করতে হয় তাহলে সেটা মেনে নিয়ে এবং সেটাকে সম্মান করে জীবন ধারণ করতে হবে। ইংরেজিতে এটাকে বলে Be comfortable in your own skin. আপনার মধ্যে যতদিন না এই আত্মবিশ্বাসটা তৈরি হবে, ততদিন মানুষ আপনার এই দুর্বলতাটা দেখতে পাবে এবং সেখানে আঘাত করবে। এটা যেহেতু একটা ম্যাচিউরিটির ব্যাপার তাই আয়ত্ত করতে মানুষের অনেক বয়স হয়ে যায়। যত কম বয়সে এই ব্যাপারটা মানুষ বুঝতে পারে তত দ্রুত জীবনে উন্নতি করতে পারে।
১৩। সার্বক্ষণিক লক্ষ্য পরিবর্তন (Moving the Goalpost)
কোন একটা লক্ষ্যে আপনি একটা কাজ করছেন এবং সেই লক্ষ্যটায় পৌঁছানোর পরে আপনাকে বলা হলো আসলে লক্ষ্যটা সেটা নয় আরো দূরে বা অন্য কিছু। আপনি মেনে নিলেন এবং আরো চেষ্টা করতে থাকলেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। সেখানে পৌঁছার পরে দেখলেন আবারো লক্ষ্য পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটাই হচ্ছে মুভিং দা গোল পোস্ট। অর্থাৎ সার্বক্ষণিকভাবে প্রত্যাশা পরিবর্তন করা যাতে আপনি কখনোই লক্ষ্যে পৌঁছে আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে না পারেন। যত চেষ্টাই করুন না কেন তাদেরকে সন্তুষ্ট করার, ভালো কিছু করার পরই শুনতে পাবেন আসলে প্রত্যাশা ছিল আরেকটু বেশি, বা কোথায় কোথায় আপনি ভুল করে গেছেন যেটা খেয়াল করা উচিত ছিল। সেই অনুযায়ী আপনি ভুলগুলো শুধরানোর পরে আবার নতুন কিছু শুনতে পাবেন। এক সময় আপনার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়বে যে আপনি কোনভাবেই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেন না এবং কোন ভাবে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেন না।
এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিত? সবকিছুর রেকর্ড এবং ডকুমেন্টেশন রাখা শুরু করেন। তাহলে যারা গোল পোস্ট পরিবর্তন করে তাদেরকে সময় মত চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। আপনার ভেতরে এই প্রস্তুতি যখন কেউ দেখতে পাবে, তখন সহজে গোলপোস্ট সরানোর মত খেলা খেলতে পারবে না। যদিও এর জন্য একটু অবিশ্বাস দরকার। কিন্তু বারবার ধোকা খাওয়ার চেয়ে মানুষকে একটু অবিশ্বাস করে সবকিছুর ডকুমেন্টেশন নিজের কাছে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। সবচেয়ে ভালো হয় যদি সরাসরি এ ব্যাপারে কথা বলতে পারেন এবং বারবার গোল পোস্ট সরানোর ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে পারেন। এই কাজটা যারা করে তারা প্রতিবাদকে ভয় পায়, এবং তাদের এই খেলা ধরা পড়ে গেলে বেশিদিন তারা এটা করতে পারে না।
১৪। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া (Minimizing)
'তোমার সাথে তো দেখি কথাই বলা যায় না'
'সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করার স্বভাবটা তোমার গেল না'
'কই বাকি সবার তো সমস্যা হচ্ছে না খালি তোমার সমস্যা হয় কেন?'
এ কথাগুলো কি পরিচিত লাগছে? এগুলো হচ্ছে আপনার অনুভূতি এবং আপনার বিষয়বস্তুগুলোকে হালকা করে দেখার একটা প্রয়াস। বাংলায় এটাকে লঘুকরণ বলা যেতে পারে। মানে পরিস্থিতির ঘনত্ব হালকা করার জন্য যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া উচিত তার চেয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে কথা বলা। এই টেকনিকটা যারা খাটান তারা চেষ্টা করেন ভিকটিমকে বিশ্বাস করাতে যে সে বাড়াবাড়ি করছে। পুরো ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করলেই সমাধান হয়ে যাবে। আসলে দায়িত্ব নিতে না চাওয়ার জন্যই এই চেষ্টাটা করা।
এরকম সমস্যায় পড়লে কি করবেন? প্রথমে আশেপাশে তথ্য সংগ্রহ করুন। আপনি কি আসলেই কোন বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন নাকি অন্য সবাই এই পরিস্থিতিতে আপনার মতই রিঅ্যাকশন দেখাতো? সবচেয়ে ভালো হয় যদি প্যাটার্ন লক্ষ্য করতে পারেন। অনেক বেশি সংখ্যক বার যদি অনেক বেশি সংখ্যক বিষয়ে এই জিনিসটা হয় তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন আপনি আসলে মিনিমাইজিং এর শিকার। এই ক্ষেত্রে প্রতিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো শক্তিশালী কাজ। কিন্তু সবার সেই পরিস্থিতি এবং সাহস থাকে না। উদাহরণ সংগ্রহ করুন যাতে আপনি তথ্য দিয়ে আপনার অবস্থানকে বোঝাতে পারেন। আরেকটি উপায় হচ্ছে, যিনি এই কাজটা করছেন, তার সাথে এই কাজটা করা। তাহলে তার কাজের (Minimizing) খারাপ প্রভাবটা অন্যদের উপর কেমন, সেটাই হয়তোবা তাকে বোঝানো যাবে।
শেষ কথা - বাড়াবাড়ি করবেন না
যেই কয়েকটা কৌশল এর কথা উপরে বলা হলো, তার বাইরেও অনেক রকমের খেলা চলে। প্রত্যেকটা মানুষ তার আশপাশের পরিস্থিতি এবং সংস্কৃতি অনুযায়ী সেগুলোকে পরিবর্তন করে এবং প্রয়োগ করে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই প্যাটার্নগুলো চিনতে পারা। নিজেকে এই ধরনের মানুষের খেলা থেকে বাঁচিয়ে চলা। শেষ একটা কথা না বললেই নয়। মনোবিজ্ঞান (সাইকোলজি) নিয়ে একটু বেশি সময় ব্যয় করলে পরে কিন্তু মানুষ প্যারানয়েড হয়ে ওঠে। অর্থাৎ সে সারাক্ষণই সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। সবার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। এবং একটা সময় নিজেই খুব বিরক্তিকর চরিত্রে পরিণত হয়। তাই নিজের নিরাপত্তার জন্য এগুলো নিয়ে জ্ঞান রাখা ভালো, কিন্তু নিজের জীবনে এর অতিরিক্ত প্রয়োগ সমীচীন নয়।
সূত্র: Doodle Facts
লেখক পরিচিতি:
ড. জাফরী আল ক্বাদরী একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বাংলাদেশের বুয়েট থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করার পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে পিএইচডি করেছেন। তিনি একজন বৈদ্যুতিক গাড়ি বিশেষজ্ঞ। জেনারেল মটরস, সিএনএইচ, ডিফেন্সসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করার পরে বর্তমানে তিনি ইলেকট্রিক ড্রাইভ মডিউল সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে স্টেলানটিস, ইউএসএ তে কর্মরত আছেন।
Comments