সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একাধারে একজন শিক্ষক, চিন্তাবিদ, পড়ুয়া, লেখক এবং আধুনিক সাহিত্যের একনিষ্ঠ গবেষক। তাঁর সান্নিধ্যে যে-ই এসেছে, তাঁকে তিনি আপন করে নিয়েছেন। আজ তাঁর প্রস্থানে শত প্রাণ কেঁদে উঠেছে। তাঁর সঙ্গে মানুষের যে সামাজিক ও ব্যক্তিগত স্মৃতি, সেসব আজ বেরিয়ে আসছে।
মানুষ একটি জীবন শেষে চলে যায়। মনজুরুল স্যারও তাঁর অধ্যায় শেষ করে প্রস্থান করলেন। এটি আমাদের জন্য এক গভীর শোক ও বেদনার বিষয়। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে আর কে আছে স্যারের মতো এমন মেধাবী, বৈচিত্র্যময় প্রতিভার অধিকারী?
কিছু স্মৃতিচারণ
১৯৮৬–৮৭ সালের ঘটনা। স্যারের এক নিকটাত্মীয় (সম্ভবত চাচাতো ভাই) আমার এক বন্ধু আমাকে বলল— "মকবুল, আমার এক বড় ভাইয়ের বিয়ে, তোমাকে একটু সাহায্য করতে হবে—বিশেষ করে ফটো ও ভিডিও ধারণের ব্যাপারে।"
সে সূত্রে সিলেট শহরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় স্যারদের বনেদি একটি বাড়িতে বেশ কয়েকদিন যাওয়া-আসা, খাওয়া-দাওয়া হলো। শহরের মধ্যে এমন এক বনেদি পরিবার—পুরোনো আসাম স্টাইলের বাসভবন। সিলেটি আসামি ঘরগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য—বাড়ির সামনে ও পেছনে বিশাল বারান্দা, আর তার পাশে নানা ফুলের গাছ। ভুবন বিলিয়া, কামিনী, বেলি - সবই ফুটে আছে।
স্যার তখন ঢাকা থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছেন, সঙ্গে আরো আত্মীয়স্বজন। বাড়িতে অনেক কাজের লোক, কিন্তু সবার মধ্যে এক উৎসবমুখর পরিবেশ। ওরা কিছুক্ষণ পর পর বিয়ের গীত গেয়ে চলেছে। তখন শুনলাম, স্যারের মা সৈয়দ মুজতবা আলীর বোনের মেয়ে।
সিলেটের বহুল জনপ্রিয় ও প্রায় আইকনিক বিয়ের গান "লিলা বালি, লিলা বালি, কি দিয়া সাজাইমু তোরে"—এই গানের রচয়িতা স্যারের মাতা।
কয়েকদিন সিলেটে কাটানোর পর সবাই ঢাকায় রওনা দিলেন, কারণ বিয়েটি ঢাকাতেই হবে। আমার বন্ধু অনুরোধ করল, আমিও যেন তাদের সঙ্গে যাই। একটি পারিবারিক মাইক্রোবাসে আমরা সবাই ঢাকায় রওনা হলাম—স্যারও সেই গাড়িতে।
স্যারের বড় ভাই দেখতে ঠিক তাঁর মতো না হলেও খুবই রসিক। তিনি ব্যাংকে চাকরি করেন। তাঁর sense of humor ছিল ঈর্ষণীয়। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন সাধারণ মানুষকেও নিয়ে এমন সব মন্তব্য করতে পারেন যে, হেসে পেট ব্যথা হয়ে যায়।
যে ভাইয়ের বিয়ে, তিনি হালকা পাতলা গড়নের, স্যারের মতো লম্বা, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির। সবাই তাঁকে উপদেশ দিচ্ছেন অবিরত। তিনি বিদেশ থেকে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে এসেছেন। স্যার বলেন- "ও ইলেকট্রনিক্স পড়েছে,কিন্তু একটা লাইট বাল্ব বদলাতে পারে না!"
ঢাকার পথে শেরপুরে তখনও ফেরি ছিল। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। আমি স্যারের পাশে পাশে ঘুরতে লাগলাম। নানা বিষয়ে তিনি বিস্ময়কর সব তথ্য জানাচ্ছিলেন—এ যেন এক জীবন্ত বিশ্বকোষ।
আমাদের পরিবারেও সাহিত্য ও বিশ্বপরিসরের নানা বিষয়ে আলোচনা হতো। সেই সূত্রে আমি জানতাম, সিলেটের এক প্রতিভাবান ইংরেজির শিক্ষক আছেন—সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আমারও তখন ইংরেজি শেখার প্রতি আলাদা আগ্রহ। আমার বাবা ১৯৪৭ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। জীবনের শেষ পর্বে আমি ছিলাম তাঁর ইংরেজি প্রকল্পের শেষ ছাত্র। ক্লাস সেভেন থেকে বাবা আমাকে আলাদা করে ইংরেজি পড়াতেন। তাই স্যারের প্রতি আমার আগ্রহের সীমা ছিল না।
ঢাকায় গ্রিন রোডের এক দোতলা ফ্ল্যাটে বিয়ের আয়োজন। প্রচুর অতিথির আগমন—এক বিশেষ ধরনের আভিজাত্য ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। আমার বন্ধু কানে কানে জানাচ্ছিল, কে কোথায় চাকরি করেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম বাড়ির বয়স্ক মহিলাদের—অনেকে দামি সাদা শাড়ি পরেছেন, সোনালি পাতলা পাড়ের; তাঁদের মধ্যে এক গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য। কেউ কেউ শুদ্ধ বাংলা বা ইংরেজিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। সিলেটি বিয়ের নিজস্ব রীতি-নীতি তাঁরা খুবই শান্ত ও সংযতভাবে পালন করছেন।
অনেক পরে, ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের ওল্ডহ্যামে স্যারের সঙ্গে আবার দেখা। স্যার এসেছিলেন ম্যানচেস্টারে কমনওয়েলথ গেমসে। সেই গেমসের অংশ হিসেবে ওল্ডহ্যামে এক ওপেন থিয়েটারে আমরা পাশাপাশি বসে দেখছিলাম অস্ট্রেলিয়ার এক নাট্যদলের পরিবেশনা—ঘন জঙ্গলে ওয়াইল্ড ফায়ারের মধ্যে থেকে চরিত্রগুলো বেরিয়ে আসছে, আগুনের খেলা যেন এক মায়াবী দৃশ্য।
স্যার তাঁর ছোট ভাইয়ের সেই বিয়ের কথা মনে করতে পারলেন। অনেক কথা হলো। বললেন, তিনি এখন আমাজন থেকে বই কেনেন এবং speed reading অনুশীলন করেন। তিনি জানালেন—একটি ছোট উপন্যাস মাত্র কয়েক ঘণ্টায় পড়ে ফেলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন স্পিড রিডিং কীভাবে কাজ করে।
তিনি আরও বললেন—বিভিন্ন কোম্পানির ইংরেজি বিজ্ঞাপনের ভয়েসওভার টেক্সট তিনিই প্রায়ই লিখে দেন। বাংলাদেশ বিমানের বিখ্যাত ট্যাগলাইন "Your Home in the Sky" তাঁরই লেখা।
এরপর স্যারের সঙ্গে আমার আর কোনো দিন দেখা হয়নি।আমার বন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে আমার সহপাঠী মাজহারুল ইসলাম—যিনি অন্যদিন প্রকাশনার কর্ণধার—তাঁর অনেক ছবি দেখেছি স্যারের সঙ্গে।
একবার সে বার্মিংহামে এলো শেক্সপিয়ারের বাড়ি দেখতে। আমি তাঁকে সারাদিন নিয়ে ঘুরালাম। এক ফাঁকে তাকে স্যারের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। সে তখন বলে গেল স্যারের সঙ্গে তার সম্পর্কের আদ্যোপান্ত গল্প।
স্যারের মাধ্যমেই তার স্ত্রীর সঙ্গে তার পরিচয়। কিন্তু সেই গল্পেও ফুটে উঠল একজন আধুনিক মানুষের প্রতিচ্ছবি—যিনি শুধু বন্ধু নন, অভিভাবকও হতে পারেন। তাঁর মৃত্যুকালে মাজহার স্যারের সঙ্গেই ছিলো।
মানুষকে চলে যেতে হয়—এ এক বিধির বিধান। মানুষ তার জীবনচক্র সম্পূর্ণ করে যায়, রেখে যায় তার কর্ম, সম্পর্কের স্মৃতি ও চলার ছাপ। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাল্যকাল থেকেই প্রতিভার উজ্জ্বলতা বহন করেছেন। তাঁর প্রতিটি কর্ম, সম্পর্ক ও চিন্তা অনন্য প্রতিভার আলোয় আলোকিত।
একজন জ্ঞানপিপাসু, বিদগ্ধ, পণ্ডিত, আধুনিক ও শিক্ষক—এমন ব্যক্তিত্ব আমাদের মাঝে আর কয়জন আছেন? আর কবে আসবেন,কে জানে।
মনজুরুল স্যার অসংখ্য লেখক,ছাত্র ও অনুরাগীর মনে পরম শ্রদ্ধেয় হয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
তাঁর আত্মার প্রশান্তি ও মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী চলচ্চিত্রকার
Comments