প্রায় সব দেশের জন্য ট্রাম্প ট্যারিফ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলে বাংলাদেশ বিশেষ কী পেল?

বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে নামানোকে বড় অর্জন হিসেবে দেখানো হচ্ছে। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানিকারকরা বেশ আনন্দিত। সরকার প্রধান তো একে বড় কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখছেন।
কিন্তু বিষয়টি কি ঠিক এমন? ৩৫ থেকে ২০ শতাংশে নামা স্বস্তিদায়ক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যদি ভালো করে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ট্যারিফ নিগোশিয়েশন টিম মোটাদাগে সব দেশকে ১৫ থেকে ২০শতাংশে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ দিয়েছে। দু'একটি দেশ যেমন ব্রাজিল এবং বতসোয়ানাসহ কয়েকটি দেশ পাঁচ থেকে দশ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ পাইকারি ১৫ -২০ শতাংশেই আছে।
এই হার সংশোধন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক কাঠামোর একটি বৃহত্তর পুনর্বিন্যাসের অংশ, যা দেশটির অনেক বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর প্রযোজ্য। শ্রীলঙ্কার হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে, আর পাকিস্তানের হার ২৯ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১৯ শতাংশ। একটা স্বস্তির জায়গা এই যে, বিশ্ব রপ্তানি মাঠে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ২০ শতাংশে থাকায় প্রতিযোগিতা থেকে বাংলাদেশ ছিটকে যাবে না বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের ওপর ট্রাম্প ২৫ শতাংশ দেয়ায় একটা অন্যরকম রাজনৈতিক আনন্দ আছে বাংলাদেশের।
চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ ও নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এই হার ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
এই শুল্ক হ্রাস স্বল্পমেয়াদে স্বস্তি আনলেও প্রশ্নও উঠছে যে বাংলাদেশ এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কী দিয়েছে? কিছু প্রতিশ্রুতি - যেমন গম, তুলা ও বোয়িং বিমান আমদানির বিষয়টি জনসমক্ষে এসেছে। তবে অনুমান করা যায়, আরও কিছু সংবেদনশীল প্রতিশ্রুতি গোপনীয়তা চুক্তির আওতায় দেওয়া হয়েছে, যা নিকট ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে না। এটি বাংলাদেশের বাণিজ্য কূটনীতিতে আরও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে কী প্রভাব রাখবে সেসব উদ্বেগ সামনে নিয়ে এসেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন অবশ্য বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় যে গোপনীয়তার বিষয়টি ছিল, চুক্তি সই হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি সাপেক্ষে তা প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে মোট ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৮.৮ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ১৮.৭ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে গেছে প্রায় ৫১.৪ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে ৯.২, কানাডায় ৩.৪ এবং জাপান, অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য বাজারে মোট ১৭.৭ শতাংশ। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ হলেও এককভাবে বড় বাজার নয়।
ভিয়েতনাম ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে মোট ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এর মধ্যে: যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৮.২ বিলিয়ন ডলার বা ৪১ শতাংশ। এতে দেখা যাচ্ছে, যৃক্তরাষ্ট্রের বাজারের উপর বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম অধিক নির্ভরশীল।
কিন্তু বাংলাদেশকে ভিয়েতনামের চেয়েও বেশি ছাড় দিতে হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ১৫ শতাংশ শুল্ক কমাতে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার কথা জানানো হয়েছে, যার ব্যয় ধরা হচ্ছে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি বিমানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও যুক্ত হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশের ২৫টি বোয়িংয়ের আদৌ দরকার আছে কিনা সেটিই প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, সয়াবিন তেলসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য কিনতে হবে -যা বাংলাদেশ সাধারণত কম দামে ভারত, ব্রাজিল বা রাশিয়া থেকে আমদানি করত। এর সাথে যুক্ত হবে অধিকতর পরিবহন খরচ যার প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে।
সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট। এর ফলে বাংলাদেশ চীনসহ কিছু দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানিতে বাধা পাবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জামে নির্ভরতা গড়ে উঠবে। এই চুক্তি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একতরফা আমেরিকান প্রভাব নিশ্চিত করতে বলে ধরে নেয়া যাচ্ছে।
স্বল্পমেয়াদী শুল্ক ছাড় পেতে গিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে বৈদেশিক ঋণ, আমদানি ব্যয় ও সামরিক নির্ভরতার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে কিনা সেটা সময়ই বলে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক অপরিহার্য। ট্যারিফ সুবিধা অবশ্যই কাম্য, তবে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও পররাষ্ট্র নীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব -ইত্যাদি বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে আগামীর বাংলাদেশে।
Comments