জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীরা অবহেলিত কেন?

দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিজমের অবসান হয় ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এ গণঅভ্যুত্থান দেশের ইতিহাসের কিংবদন্তিতুল্য আখ্যান। দু'হাজারের অধিক নিহত এবং ৩০ হাজারের অধিক আহত ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সফল হয় এই অভ্যুত্থান। অভূতপূর্ব এ অভ্যুত্থানে অংশ নেয় সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে আলেম-ওলামা এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীরাও। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনাটা হয় মূলত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ইসলামও সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে। একই সঙ্গে সব ধরনের জুলুম ও বিশৃঙ্খলার বিপক্ষে। তাই ২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানেও রাজপথে তাজা রক্ত প্রবাহিত করে দেশের আলেম এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীরা। আলেম সমাজ ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যেভাবে রক্ত দিয়েছেন, শতাধিক শহীদ হয়েছেন; তেমনি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানেও শতাধিক আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছে, আহত হয়েছে অনেকে। অনেক ইমাম-খতিব বিপ্লবের পক্ষে জুমার বয়ান দেওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। এ ছাড়া সারাদেশে অসংখ্য আলেম-মাদরাসা ছাত্র শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছে। আন্দোলন ছিল রাজপথে এবং অনলাইনে। আলেম সমাজ যেভাবে রাজপথ তাজা রক্তে রঙিন করেছেন, তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারও লাল করে সংহতি প্রকাশ করেছে।
সারাদেশে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার সঙ্গে রাজপথে নেমে এসেছিল আলেম সমাজ ও মাদরাসার ছাত্ররাও। জুলাই আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা ছিল পুরোদস্তুর রণক্ষেত্র। যাত্রাবাড়ী বড় মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা রিদওয়ান হাসান আহ্বান করেন সংহতি সমাবেশ। ৩ আগস্ট সকালে কাজলা পেট্রোল পাম্পের সামনে 'সাধারণ আলেম সমাজে'র ব্যানারে দেশের পরিচিত আলেমদের নিয়ে সংহতি সমাবেশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সর্বাত্মক সংহতি প্রকাশ করেন। সেখানে স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান নন্দিত আলেম ও বিদগ্ধ গবেষক মাওলানা মুসা আল-হাফিজ, মাওলানা আবদুল্লাহ আল-মাসউদ, মাওলানা উসামা সিরাজ, মাওলানা তানজিল আরেফিন আদনান, মাওলানা আশরাফ মাহদিসহ অনেক আলেম। সেখানে অবস্থান কর্মসূচি শেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি কাজলা থেকে কুতুবখালী খাল পার হয়ে আরো সামনে গিয়ে শেষ হয়। মিছিল শেষে মোনাজাত এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এভাবে যাত্রাবাড়ীর আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীরা মিশে যান জুলাই বিপ্লবের অংশ হয়ে।
রাজধানী বারিধারায় অবস্থিত জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার ছাত্র-উস্তাদরা জুলাই বিপ্লবে সর্বাত্মকভাবে আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তারা আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন মাদরাসার সব দরজা। ১৫ জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঘোষিত 'বাংলা ব্লকেড'কর্মসূচিতে সারাদেশ যখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, তখন মাদরাসা-সংলগ্ন নতুনবাজার মহাসড়ক ব্লক করে অবস্থান নেয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা। সে সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন তীব্র তাপদাহ ও কাঠফাটা রোদে পিপাসায় হাপিত্যেশ করছিল, তখন বারিধারা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী জরুরি ভিত্তিতে মাদরাসার ছাত্রদের ডেকে ভলান্টিয়ারের কাজে নিয়োজিত করেন এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পানি, শরবত, স্যালাইন ইত্যাদি পানীয় খাবার সরবরাহ করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি তিনি এটাও বলে দেন, তাদের বিশ্রাম ও ওজু-ইস্তিঞ্জার ব্যাপারে নির্দ্বিধায় মাদরাসায় আসতে বলবে। তাদের জন্য মাদরাসা গেট সর্বদা উন্মুক্ত। বারিধারা মাদরাসার স্বেচ্ছাসেবী প্রায় অর্ধশত ছাত্রদের ভাষ্য মতে, সেদিন আমরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে কত হাজার লিটার শরবত আর কতশত বিস্কুট বিতরণ করেছিলাম সংখ্যাটা বলতে পারব না। ৫ আগস্টের পর বারিধারার শত শত তালিবুল ইলম রাস্তাঘাট পরিষ্কার ও ট্রাফিক পুলিশের ভূমিকা পালন করে। প্রায় প্রতিদিন ট্রাফিকে থাকা বৈষম্যবিরেধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মাঝে অসংখ্য বিরিয়ানির প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে বারিধারা মাদরাসার পক্ষ থেকে। মুহতামিম সাহেব স্বয়ং এর মান নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রতিনিয়ত ট্রাফিকের দায়িত্বপালনরত অসংখ্য শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে খাবার বিতরণসহ তাদের বিশ্রাম, ওজু ও ইস্তিঞ্জার জন্য মাদরাসার গেট উন্মুক্ত ছিল সর্বদা। দেশের অন্যান্য মাদরাসাগুলোও জুলাই বিপ্লবে এমননি ভূমিকা পালন করেছে বলে আমরা জানি।
প্রাথমিকভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ৮০ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যা দেশের সকল জাতীয় দৈনিক ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই তালিকায় আছে বেশকিছু নাবালক শিশু শিক্ষার্থী। তারমধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকায় পবিত্র কুরআনের হাফেজের সংখ্যা ২০ জনের অধিক নিহত। তাছাড়া তালিকা ও তালিকার বাইরে ও রয়েছে অনেক আলেমসমাজ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ শোষণ ও ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের অধ্যায়। শাপলা চত্বরের গণহত্যা, '২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলনের দমন–পীড়ন, জেল-জুলুম, নির্যাতন এবং সর্বশেষ '২৪–এর জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আলেম সমাজের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেমন আলেম সমাজের অভিভাবক মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর ঘোষণা করেছিলেন, 'এ যুদ্ধ জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রাম', তেমনি ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানেও রাজপথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত করে দেশের আলেম সমাজ এবং মাদরাসা শিক্ষার্থীরা।
দেশের আলেম সমাজ ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে যেভাবে রক্ত দিয়েছেন, তেমনি ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানেও আন্দোলনের পক্ষে বক্তব্য দেওয়ায় শতাধিক আলেম ও মাদরাসা শিক্ষার্থী শহিদ হয়েছেন, অঙ্গ হারিয়েছেন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে জুমার খুতবা দেওয়ায় চাকরি হারিয়েছেন। এ ছাড়া সারা দেশে অসংখ্য আলেম শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন।
সকলের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি " জুলাইয়ের গাদ্দার বাটপার চিটিংবাজ মুনাফেকদের চিনে রাখুন- জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অবদানকে অবমূল্যায়ন করাকে নতুন ফ্যাসিস্টের বার্তা আগমনী মনে হচ্ছে। সেই সাথে আরেকটি জুলাই বিপ্লবে হাতছানি দিয়ে ডাকছে -
২ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন দেখে যেমন হতবাক হলাম অন্য দিকে মনপ্রাণ থেকে ধিক্কার ও তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলতে চাই - ইসলামি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অবদানকে ভুলে গিয়ে চলবে না-। এতবড় একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে কিন্তু মাদ্রাসা ছাত্র শিক্ষার্থীদের কাউকেই এখানে দাওয়াত করা হয়নি। তাহলে কিসের এধরণের আচার-আচরণ কাম্য নয়। জুলাই বিপ্লব বিক্রি করে আর কতদিন চলবে। সময় আর বেশি দিন নয়- সবকটি দালাল মীরজাফরদের একটা একটা করে ধরে এনে জনতার আদালতে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে । মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অবদানকে অস্বীকৃতি অস্বীকার করে যাবার মতন এমন সুযোগ নেই বর্তমান সময়ে জুলাই বিপ্লবের পরবর্তী। যেখানে সব রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত সেখানে কোন কারণে নেই জুলাই বিপ্লবের সাথে বীর রণাঙ্গনের সৈনিক এদেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং মাদ্রাসার শিক্ষক অথবা এই সমমনা ইসলামি রাজনৈতিক দলের এমন কাউকেই দাওয়াত দেয়া হয়নি কেন কোন কারণে কাদের ইশারায় এমন অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে সেই বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করার জন্য বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজনকারী সবাইকে জবাব দিতে হবে। আর না হয় জুলাই বিপ্লব বিক্রিতে কারা কারা জড়িত রয়েছে অন্তর্গতভাবে বাদবাকি অন্য চাপাবাজদের মুখোশ উন্মোচন করা সময়ের ব্যাপারমাত্র।
শনিবার গভীর রাত- সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নজরে আসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এর আজকের এই অনুষ্ঠান বিষয়টি। এতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সাথে একদম প্রথম সারিতে যাদের অবদান অতুলনীয় সেই সমস্ত মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বা সমমনা ইসলামি রাজনৈতিক দলের কাউকে অতিথি হিসেবে দাওয়াত না দেয়ায় স্পষ্টই প্রতীয়মাণ - এখানে বৈষম্য নামের সাথে ফ্যাসিস্ট আচরণ অন্তরায় - হিসেবে মনে হচ্ছে।
আজকের এই অনুষ্ঠানে দেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ইসলামি দলের নেতারাদের বাদ দিয়ে এমন আয়োজন কে ফ্যাসিস্ট আচরণ হিসেবে মনে করছে - ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন নামক এই সংগঠন। উক্ত সংগঠনের পক্ষ থেকে এমন অমানবিক আচরণ জুলাই বিপ্লবের প্রথম সারিতে যাদের অবদান অতুলনীয় সেই সমস্ত মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাউকে মূল্যায়ন না করার কারণে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
স্মরণ করে দিতে চাই - জুলাই বিপ্লব শুধুমাত্র এক জুলাই ২০২৪ দিয়ে তার বিজয় অর্জন হয়নি। তার সূচনা লগ্নে যেতে হবে - তা হচ্ছে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলন যখন থেকে শুরু হয়েছে সেই সময় থেকে হিসাব টেনে নিয়ে আসতে হবে। বিগত ২০১১ সাল থেকে শুরু হয়েছে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। তখনকারদিনে সময়ের মধ্যে ও যারা স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের আক্রমণে গুম খুন অপহরণ পঙ্গুত্ববরণ নির্যাতিত নিপিড়ীত হয়ে জুলুমের শিকার হয়েছেন তাদেরকে অন্য আড়ালের বাইরে রেখে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিজয়ের অর্জন ও অংশীদারত্বের চাপাবাজি করে গেলে চলবে না-।
সকলের নিকট উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি " জুলাইয়ে গাদ্দার বাটপার চিটিংবাজ মুনাফেকদের চিনে রাখুন-
আওয়ামীলীগ ছাড়া আমার বিশেষ কোনো শত্রু নেই। জুলাইয়ে আমার সাথে থাকা ভিন্ন আদর্শের, ভিন্ন পোশাকের, ভিন্ন লিঙ্গের প্রত্যেককেই আমি বন্ধু মনে করি। এই মানুষগুলোর যেকোনো প্রয়োজনে কেউ না থাকলেও আমি পাশে দাঁড়াব। কিন্তু জুলাইকে কুক্ষিগত যারা করেছেন গত এক বছর, যাদের কারণে নিজেকে "জুলাই যোদ্ধা" পরিচয় দিতে সংকোচ করি, এদের ভয়ঙ্কর বেইজ্জতির দোয়া আমি সবসময় করে যাবো। আমার জুলাই এত ঠুনকো না যে এদের পতনে জুলাই তার স্বকীয়তা হারাবে।
আমাদের সামনে আরেকটি জুলাই হাতছানি দিচ্ছে। আমরা একটি বিপ্লবের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রথাগত রাজনীতি বা সামাজিকতা আমাদের আকৃষ্ট করে না। ২০২৪ এর জুলাই শুরু হলেও এই জার্নিটা আরও অনেকদূর। মাঝপথে অনেকেই নেমে পড়বে, অনেকেই উঠবে। অনেকেই পরিস্থিতি না বুঝে অপ্রয়োজনীয় শট খেলে আউট হবে।
আমি মনে করি জুলাই বিপ্লবের জলকামান গোলাগুলি লাশের উপরে লাশেরস্তুপ এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যুদ্ধ শেষ সমাপনী হয়নি এখনও। আমরা মাটি কামড়ে পড়ে আছি, কারণ ৫ দিনের টেস্টে সবে মাত্র প্রথম দিন।
মোহাম্মদ অলিদ বিন সিদ্দিক তালুকদার: সভাপতি, ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন
(এখানে লেখকের বক্তব্য তাঁর নিজের। এর সঙ্গে ঢাকা জার্নালের কোনো সম্পর্ক নেই)
Comments