দক্ষিণপন্থী রাজনীতি মানুষের কাছে পৌঁছুতে পেরেছে

রাজনীতিতে হামেশাই নানা ইস্যু তৈরি হয়। কিছু কিছু চলমান থাকে যেমন বর্তমানের বিতর্ক হলো জাতীয় নির্বাচন কী হবে? হলে কবে হবে? নির্বাচনের পরিবেশ কী আছে?
এর মধ্যেই এক নতুন ইস্যু নিয়ে এসেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, 'রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান হচ্ছে, আমি এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন'। উদারনৈতিক রাজনীতির বিপক্ষে এই দক্ষিণ পন্থার সক্রিয়তার প্রশ্নে কোনো দল বা গোষ্ঠীর নাম না নিলেও তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইসলামপন্থি দু-একটি দল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামী ভাবধারার ডানপন্থী দলগুলোর বড় ধরনের তৎপরতা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। 'ধর্মনিরপেক্ষ' বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত। বিএনপিকে উদারপন্থী রাজনৈতিক দল হিসেবেই বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশে। তবে দলটির সঙ্গে ইসলাম ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘদিনের সু-সম্পর্ক আছে। তাই হঠাৎ করে বিএনপি মহাসচিবের মুখ থেকে দক্ষিণপন্থিদের উত্থানে উদ্বেগের কথা উঠে আসার ঘটনাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
কিন্তু এই দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কি কেবল বাংলাদেশেই বাড়ছে? বিষয়টি তেমন নয়। যদি পাশের দেশ ভারতের কথা ধরা হয় তাহলে কোন সংবেদনশীল মানুষই অস্বীকার করবে না শাসক দল বিজেপি একটি চরম দক্ষিণপন্থী দল যার রাজনৈতিক দর্শনও হিন্দুত্ববাদ।
বলতে গেলে গোটা দুনিয়াই দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকছে বলে ধরে নেয়া যায়। ধনী দেশ-দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমেরিকায় ট্রাম্প জামানা ছলছে। ব্রিটেনে এই দক্ষিণপন্থীরাই ব্রেক্সিট নিশ্চিত করেছে। ফ্রান্সে অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন লি পেন এবং জার্মানিতে নব্য নাৎসি-প্রভাবিত এএফডি প্রধান বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইতালি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডে এখন উগ্র দক্ষিণপন্থীদের শাসন চলছে। এমনকি সুইডেনেও সরকারের প্রধানতম সমর্থক এক নব্য-নাৎসি দল। উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে তুরস্কতে এরদোয়ান একজন দক্ষিণপন্থী শাসক। ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থীরা লুলা দা সিলভার কাছে হারলেও তাদের নেতা বোলসোনারো পেয়েছে ৪৯ শতাংশ ভোট। লাটিন আমেরিকার যে সব দেশে বামপন্থীরা ক্ষমতায়, সেখানেও সংসদে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি রীতিমতো প্রবল।
কেন এমন হচ্ছে? একটা কারণ হতে পারে যে, পুঁজিবাদের প্রবল প্রতাপে দুনিয়া জুড়ে আর্থিক অসাম্য এত বাড়ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণপন্থীদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। এখানে বামপন্থীরা যে জায়গা নিতে পারতো সেটা তারা হারিয়েছে। তবে এ কথাও সত্য যে, দক্ষিণপন্থী বলে যারা নেতৃত্বে আছেন সেই ট্রাম্প, লি পেন, অরবান, এরদোয়ান, মাইকেল ফারাজারা সবাই অতি ধনী। ভারতের নরেন্দ্র মোদী নিজে ধনী না হলেও তার সখ্য আদানী, রিলায়েন্সসহ অতি ধনিক শ্রেণির সাথেই।
মানুষ এদের সমর্থন করছে জেনে বুঝেই। আসলে মানুষ বৈষম্য নিয়ে ততখানি মাথা ঘামায় না, যতখানি চিন্তা করে চাকরি বা পরিবারের ভাত-কাপড়ের সংস্থানের নিরাপত্তা নিয়ে। গোটা দুনিয়াতেই দক্ষিণপন্থী নেতারা সেই সংস্থানের লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আর্থিক বিপন্নতার সময় তো মানুষকে বামপন্থার দিকে ঠেলার কথা, এ ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বামপন্থীরা দুই একটি পকেট ছাড়া আর তেমন কোথাও সংগঠিত নয়। বিশ্ব জুড়েই বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের জোর কমেছে।
দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সংখ্যাগরিষ্ঠের মনে ভিত্তিহীন ভয় উস্কে দেওয়ার রাজনীতিও করে চলেছে দক্ষ ভঙ্গিতে। এটা এশিয়া আফ্রিকায় বেশি। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা ও কুৎসার প্রবল প্রতাপ চলছে এবং এখানেও দক্ষিণপন্থীদের জয় জয়কার।
আমাদের মতো দেশে বামপন্থী সুশীল নাগরিক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি সাধারণ মানুষের চোখে এলিট বা অভিজাত। দক্ষিণপন্থী রাজনীতির অবস্থান এদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ নাগরিক আভিজাত্যের বিরুদ্ধে, যার সঙ্গে সাধারণ মানুষ একাত্ম বোধ করে। এক কথায় বলা চলে, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির বিরোধিতা 'উদার অভিজাত'দের প্রতি, আর্থিক অভিজাতদের প্রতি নয়। কারণ দক্ষিপন্থী রাজনীতি যারা পরিচালনা করেন তারা নিজেরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী।
মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য বামপন্থী রাজনীতি উপযুক্ত নয়। সেই রাজনীতি উন্নয়ন কর্মসূচিকে মানুষের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নির্ভর করেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর, আমলাতন্ত্রের উপর, সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর যেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্যদিকে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি তাদের সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছেছে নানা সেবা ও সহযোগিতা নিয়ে। যারা সরাসরি মানুষের কাছে যায় তাদের রাজনীতির পাঠ নিতে সাধারণ মানুষের আপত্তি থাকবে কেন?
লেখক: সাংবাদিক
Comments