স্মার্ট রেমিট্যান্স চ্যানেলের জন্য বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্কারের প্রয়োজন

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেও, একটি বড় প্রশ্ন এখনো অনুত্তরিত: কেন এখনো পেপাল বা স্ট্রাইপের মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি?
সীমাহীন ডিজিটাল লেনদেনের এই যুগে এমন গেটওয়েগুলোর উপস্থিতি কেবলমাত্র সুবিধাজনক ব্যবস্থার প্রশ্ন নয়, বরং এটি হলো এমন একটি পথ, যার মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত বৈধ উপার্জন এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোর তরফ থেকে ফ্রিল্যান্সার, এসএমই ও স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের পেমেন্ট—দুই ক্ষেত্রেই বিপুল সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক মূল্য উন্মোচিত হতে পারে।
রেমিট্যান্স প্রবেশে যেসব বাধা
ভারত ও ফিলিপাইনের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায়, বাংলাদেশ এখনো একটি সমন্বিত ডিজিটাল ফাইন্যান্স নীতির আওতায় আন্তঃসীমান্ত পেমেন্ট অ্যাগ্রিগেটরদের জন্য উপযোগী লাইসেন্সিং কাঠামো গড়ে উঠেনি। বর্তমান আইনি কাঠামো, বিশেষ করে ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন এক্ট এবং পেপাল বা স্ট্রাইপের এর মতো প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা সহায়ক নয়।
এর পাশাপাশি, লেনদেন পুনরাবাসন, অর্থ পাচার বিরোধী আইন, কমপ্লায়েন্স প্রটোকল এবং KYC-এর সমন্বয়করণ ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্টতার অভাব বাংলাদেশকে FinTech প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য একটি দ্বান্দ্বিক জয়গায় লেখে দিয়েছে।
কেন এখনই এই বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার ইকোসিস্টেম থেকেই বছরে ৫০০ মিলিয়ন ডলার এর বেশি উপার্জিত হয়। কিন্তু সীমিত পেমেন্ট গেটওয়ে বিকল্প না থাকায় এর অনেকটাই অনানুষ্ঠানিক বা উচ্চ ফি-যুক্ত চ্যানেলের মাধ্যমে পাঠানো হয়।
একইভাবে, বিশ্বব্যাপী পরিচিত গেটওয়ের অনুপস্থিতির কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকেই এখনো ছোট অঙ্কের পেমেন্ট পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যয়বহুল প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করতে।
সরাসরি বললে: এই ব্যবস্থাটি কাজ করছে ব্যবস্থার কারণে নয়, বরং ব্যবস্থার বাইরে থেকে কাজ করেই চলছে।
নীতিনির্ধারকদের করণীয় কী হতে পারে
বাধাগ্রস্ত এই প্রবাহ উন্মোচনে কিছু নির্দিষ্ট নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—
- রেগুলেটরি স্যান্ডবক্স: বাংলাদেশ ব্যাংক বা বিএফআইইউ পরীক্ষামূলকভাবে নির্ধারিত শর্তে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে প্ল্যাটফর্ম পরিচালনার অনুমতি দিতে পারে।
- Cross-border Licensing: বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (BIDA) বা বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় নতুন ধরনের 'Digital Remittance Service Provider' লাইসেন্স চালু করা যেতে পারে।
- কর-ছাড় প্রণোদনা: অনুমোদিত FinTech প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের উপর সাময়িকভাবে ভ্যাট মওকুফ করলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
- দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রা নিষ্পত্তি (FX Clearance): SME খাতের রপ্তানি আয় আরও দ্রুত আহরণে ডিজিটাল উইন্ডো ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ
ভারত ও ফিলিপাইন এই বিষয়ে কার্যকর উদাহরণ তৈরি করেছে—
ভারতের ক্ষেত্রে PayPal-এর লেনদেন সীমা বৃদ্ধি, স্থানীয় কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রমের অনুমতি, এবং RBI-এর স্যান্ডবক্স পলিসি আন্তর্জাতিক গেটওয়েগুলোর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে, কীভাবে একটি ঝুঁকি-মিতব্যয়ী পন্থায়ও উন্নয়ন সম্ভব।
অন্যদিকে, ফিলিপাইন তাদের Digital Payments Transformation Roadmap চালু করে এবং নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্যাশ এজেন্ট হিসেবে কাজের সুযোগ দিয়ে গেটওয়ে প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিস্তৃত হতে সহায়তা করেছে। এর ফলে শুধু বৈদেশিক লেনদেনই সহজ হয়নি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও তারা একটি বিশ্বনেতায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য এই অভিজ্ঞতাগুলো নীতিগত সমন্বয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতির গুরুত্বকে তুলে ধরে।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ
জাতীয় বাজেট ২০২৫-এর প্রেক্ষাপটে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রেমিট্যান্স প্রবাহকে উৎসাহিত করার বাইরেও, সরকার চাইলে এমন একটি আধুনিক নিয়ন্ত্রক রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারে, যা বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল অর্থনীতিকে ব্যবহার করে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে গতিশীল করবে।
এই গেটওয়েগুলোর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা শুধু পিছিয়ে পড়া থেকে মুক্তি নয়, বরং এটি একটি ডিজিটাল-প্রথম, বৈশ্বিকভাবে সংযুক্ত অর্থনীতির পথে বাংলাদেশের রূপান্তরের ভিত্তি স্থাপন করার সুযোগ।
এই নিবন্ধটি তৈরি করা হয়েছে ঢাকা জার্নালের সাথে ডীপ ডাইভ -এর সহযোগিতায়
Comments