গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ২ যুবকের প্রাণ গেলো, নিখোঁজ-৫, বাড়ীতে চলছে শোকের মাতম
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার ননীক্ষির ইউনিয়নের পশ্চিম লখন্ডা গ্রামের আকোব আলী শেখের ছেলে এনামুল শেখ। পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনতে ২১ লাখ টাকার বিনিময়ে দালাল এনামুলের মাধ্যমে গত এক মাস আগে ইতালিতে যাবার উদ্দেশ্যে লিবিয়া পাড়ি জমায়। ইচ্ছা ছিলো বিদেশে চাকুরী করে পরিবারের আর্থিক অভাব ঘোচানোর। কিন্তু তার স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটলো ভূমধ্যসাগরে।
শুধু এনামুল শেখ নয় তারমত করুন পরিনতি ঘটেছে একই গ্রামের জাহিদ শেখের ছেলে আনিস শেখের।
আর নিখোঁজ রয়েছে ৫ যুবক। তারা হলেন, একই উপজেলার পশ্চিম লখন্ডা গ্রামের আওলাদ শেখের ছেলে ইব্রাহিম শেখ, খালেক মোল্লার ছেলে হাবিবুল্লাহ মোল্লা সোহেল, হায়দার মিনার ছেলে আশিক মিনা, ইকরাম মিনার ছেলে দুলাল মিনা ও পাশ্ববর্তী গুনহার গ্রামের হাফিজ মিনার ছেলে নিয়াজ মিনা।
নিহত ও নিঁখোজ পরিবারগুলোর বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম। নিহতদের মরদেহ ও নিখোঁজদের সন্ধান করে তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।
আজ বুধবার সকালে সরেজমিনে পশ্চিম লখন্ডা গ্রামে গিয়ে জানাগেছে, দালালের মাধ্যমে প্রায় ২১ লাখ টাকা করে দিয়ে গত অক্টোবরে ইতালির উদ্দেশ্যে অবৈধভাবে লিবিয়া যান মুকসুদপুর উপজেলার ননীক্ষীর ইউনিয়নের পশ্চিম লখন্ডা ও গুনহার গ্রামের ৮ যুবক। গত ১৩ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাতে লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরের আল–খুমস তীরের কাছে উল্টে যায় তাদের বহনকৃত ট্রলার। এ ট্রলারে ছিলেন বাংলাদেশের ২৬ নাগরিক। তাদের মধ্যে ৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর ১৬ নভেম্বর নৌকা ডুবির খবর বিষয়টি বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসলে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে স্বজনরা জানাতে পারেন পশ্চিম লখন্ডা গ্রামের আকোব আলী শেখের ছেলে এনামুল শেখ ও জাহিদ শেখের ছেলে আনিস শেখ মারা যায়। এ ঘটনায় আরো ৫ যুবক নিখোঁজ রয়েছে।
এরপর থেকেই নিহত ও নিখোঁজ যুবকদের বাড়ীতে চলছে শোকের মাতম। স্বজন, প্রতিবেশি ও গ্রামবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঘটনার খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে মুষড়ে পড়েছে নিহত ও নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা। নিহতদের মরদেহ ও নিখোঁজদের সন্ধান করে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবী ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর।
ওই নৌকা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া পশ্চিম লখন্ডা গ্রামে হায়দার শেখের ছেলে প্রত্যক্ষদর্শী আবুল শেখ ধলা (৩০) ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের সাথে ১৬ নভেম্বর কথা বলেছেন। তিনি তখন নৌকা ডুবিতে এনামুল ও আনিসের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। এ ঘটনায় নিহত এনামুল শেখ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া আবুল শেখ ধলার আপন চাচাত ভাই।
ভিডিও কলে ধলা বলেন, আমাদের নৌকার ঠিক মাঝে অরেকটি নৌকা উঠে যায়। নৌকার মাঝে এনামুল ও আনিস বসে ছিল । মাঝে যারা ছিল তারা সবাই মারা গেছে। নৌকার সামনে যারা ছিল তাদের তেমন ক্ষতি হয়নি। আমি পেছনে ছিলাম। পেছনের সবার শরীর কেটে ছিড়ে গেছে। অনেকে সাগরে ভেসে গেছে। আবার অনেকে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে সাগরে ভেসে ছিল। উদ্ধার কর্মীরা তাদের উদ্ধার করেছে। সবার শেষে তারা আমাকে উদ্ধার করে।
নওখন্ডা গ্রামের শাহজালাল মিয়া ও ইমাম হোসেন বলেন, বিদেশগমন সংক্রান্ত সচেতনতার পাশাপশি, দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়া বিদেশে বৈধ অভিবাসন সুযোগ বাড়ানো ছাড়া এ মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।
ননীক্ষির ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য আলমগীর মোল্যা বলেন, "লাখ লাখ টাকা খরচ করে যুবকদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। পরিবারগুলো ধার দেনা, গচ্ছিত ও জমি বিক্রির টাকা দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে। অবৈধ সমুদ্র পথে যাওয়াই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও বেকারত্ব ঘুঁচিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই তাদের এ কাজে বাধ্য করছে। এ যাত্রায় আমার ওয়ার্ড থেকে ৮ জন লিবিয়া গেছে। নৌকায় ইটালী যাওয়ার পথে তারা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এটি বন্ধ হওয়া দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ ঘটনার পর স্থানীয়রা প্রশাসনের কঠোর নজরদারি দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে দালালচক্র প্রতারণা করে এলাকার অসহায় মানুষকে অবৈধ পথে ইটালী পাঠাচ্ছে।আর এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে।
মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, "নিহত দুইজন ও নিখোঁজদের বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। পরিবারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উচ্চ পর্যায়ে তথ্য পাঠানো হয়েছে।"
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান অধিদপ্তরে গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্টীপদ রায় বলেন, বৈধ অভিবাসন সুযোগ সরকার সৃষ্টি করেছে। সরকারিভাবে বৈধ পথেই ইটালী যাওয়া যায়। এ ব্যাপারে আমরা জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জনসচেতনতামূলক সভা-সমাবেশ করছি। তারপরও মানুষ অবৈধ পথে ইটালী যাচ্ছে। মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এটি দুঃখজনক। আমার বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।
Comments