ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চুক্তি ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অর্থ কি
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তির রূপরেখায় সম্প্রতি স্বাক্ষর করেছে। এটি স্বাক্ষরের দিন (৩১ অক্টোবর) ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তির লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক বা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা। এ ছাড়া, এটি এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। ২০২১ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় এ অঞ্চলকেন্দ্রিক একটি কৌশল ও নীতিমালাও প্রকাশ করা হয়। প্রশ্ন হলো কী আছে এই কৌশলে? সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তির গুরুত্বই বা কী?
সম্প্রতি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তির রূপরেখায় স্বাক্ষর করেছে। এটি স্বাক্ষরের দিন (৩১ অক্টোবর) ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তির লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক বা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদার করা। এ ছাড়া, এটি এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বেশ কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। ২০২১ সালের অক্টোবরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় এ অঞ্চলকেন্দ্রিক একটি কৌশল ও নীতিমালাও প্রকাশ করা হয়। প্রশ্ন হলো কী আছে এই কৌশলে? সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তির গুরুত্বই বা কী?
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল হলো একটি ভূরাজনৈতিক ধারণা। যেখানে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর এই দুই অঞ্চলের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে একসঙ্গে বিবেচনা করা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো- এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্বাধীন, উন্মুক্ত ও স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করা।
চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জোরদার করাও এই কৌশলের লক্ষ্য। বিশেষ করে দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরে মুক্ত নৌচলাচল নিশ্চিত করা; যাতে কোনো রাষ্ট্র একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার জলসীমা ও ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন বন্দরে চীনের প্রভাব দেশটিকে স্থায়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের কারণে অর্থনৈতিকভাবেও চীন এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান রাষ্ট্রগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। দ্য ডিপ্লোম্যাট-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উদয়ন দাস বলেছেন, এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র দুটি কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত ধারণার জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, এ অঞ্চলজুড়ে চীনের প্রভাব মোকাবিলা এবং দ্বিতীয়ত, অবনতির দিকে থাকা মার্কিন জোট ব্যবস্থা পুনর্জাগরণের চেষ্টা করা।
এশিয়া সুরক্ষিত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রও নিরাপদ
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে যে নথি প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা স্মরণ করে বলা হয়েছে, 'আমাদের দেশ শুধু তখনই সুরক্ষিত হবে, যখন এশিয়াও সুরক্ষিত থাকবে।'
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ও ভারত পারমাণবিক শক্তিধর। অর্থনীতিতে, প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। এই অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও চাকরি করেন। ফলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও পায় যুক্তরাষ্ট্র। তাই এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসব দিক বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের 'ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি'কে নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়াতে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানকেও সমর্থন জানিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির রূপরেখায় স্বাক্ষরের পর মার্কিন যুদ্ধ বিষয়ক সচিব পিট হেগসেথও তাঁর এক্স (আগের টুইটার) অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টে বলেছেন, এই চুক্তি প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেবে। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও প্রতিরোধ সক্ষমতার অন্যতম ভিত্তি।
কী আছে চুক্তির রূপরেখায়
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোও বলছে, চুক্তিটি ভারত-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা সম্পর্কের নীতিগত দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। এর প্রভাব পড়বে ভারতের নিরাপত্তা, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে।
এই চুক্তির মাধ্যমে স্থল, সমুদ্র, আকাশ, মহাকাশ ও সাইবারসহ সব প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সমন্বয় আরও জোরদার হবে। যাতে দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী যৌথ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও কার্যকর ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে। অর্থ্যাৎ, সামরিক সহযোগিতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি, গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান এবং উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চুক্তিটি করা হয়েছে।
চুক্তির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে শনিবার একটি নিবন্ধ লিখেছেন ভারতের সাবেক সামরিক কর্মকর্তা বিপি কাৎজু। তিনি বলছেন, চুক্তিটি প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের যৌথ উৎপাদনের পথ প্রশস্ত করবে। ভারতের 'মেড ইন ইন্ডিয়া' উদ্যোগের আওতায় মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
উভয় দেশ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় নিরাপদ তথ্য বিনিময় ও গোয়েন্দা সহযোগিতার জন্য সমন্বিত প্রক্রিয়া গড়ে তুলবে। এই কাঠামো ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। যা সামুদ্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ ও চীনের সম্প্রসারণবাদী কর্মকাণ্ড মোকাবিলায়ও ভূমিকা রাখবে।
সামরিক সরঞ্জাম কেনাবেচা
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠক হয়। তখনও প্রতিরক্ষা খাত ছিল আলোচনার প্রধান বিষয়। ট্রাম্প তখন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়াতে চায়। নয়াদিল্লি এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে সে বিষয়েও ইঙ্গিত মেলে। কিন্তু এরপর আলোচনায় ভাটা পড়ে। কারণ, রাশিয়ার তেলের ওপর ভারতের নির্ভরতা ও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক; ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
রাশিয়া এখনও ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তবে সম্প্রতি ভারত ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা সামগ্রী কিনতে আগ্রহী। বিবিসি বলছে, উভয় দেশ উচ্চ-পর্যায়ের বাণিজ্য আলোচনা চালাচ্ছে। যেটির লক্ষ্য নভেম্বরেই একটি চুক্তি করা।
ভারতের লাভ কী
বিপি কাৎজু লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ভাগ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ভারত উন্নত ড্রোন, রাডার ব্যবস্থা এবং সম্ভবত পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের (এফ-৩৫ স্টেলথ) মালিক হতে পারবে। এই অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ভারতের সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিক করবে এবং নতুন নিরাপত্তা হুমকি মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতা বাড়াবে।
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবেও ভারতের ভূমিকা শক্তিশালী হবে বলে উল্লেখ করেছেন বিপি কাৎজু। তা ছাড়া, প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা ভারত-আমেরিকা বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সাম্প্রতিক শুল্কবিষয়ক মতবিরোধ পেরিয়ে উভয় দেশ আরও বাস্তববাদী আলোচনায় অগ্রসর হবে। বিপি কাৎজু বলছেন, এই চুক্তি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নয়াদিল্লির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।
Comments