ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম করছেন গাজার নারীরা
ইসরায়েলের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক ক্ষত কাটিয়ে উঠতে গাজার নারীরা কঠিন সংগ্রাম করছেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরেও সেই ক্ষতি তাদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।এমনই দু'জন নারীর সংগ্রামকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
আবু সবিয়াকা
ফিলিস্তিনি রাশা আবু সবিয়াকা ইসরায়েলের গণহত্যার দুই বছর পর অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। চারটি বোমা হামলার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে গেছেন এবং দু'বার হামলার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে তাকে টেনে বের করতে হয়েছে।
কিন্তু যুদ্ধবিরতির পরও যুদ্ধ এবং তার পরিণতি তাকে এখনো হত্যা করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন, তার ক্যান্সারের কারণও ছিল অবিরাম বোমাবর্ষণ এবং রকেট হামলার সময় নির্গত কেমিক্যাল।
তিনি বলেন, 'আমার প্রায়ই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। যুদ্ধের কারণে গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ এবং বন্ধ ক্রসিংগুলোর কারণে কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই এবং বিকল্প চিকিৎসাও নেই। এখানে সবকিছুই স্থবির।'
আবু সবিয়াকা আরও বলেন, 'আমি প্রতিদিন আমার বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেতাম, কারণ আমার মনে হতো আমি মৃত্যুশয্যায় আছি।'
শারীরিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির পাশাপাশি তিনি বলছিলেন, তার এই দুর্দশা মানসিক সুস্থতার ওপর বড় প্রভাব ফেলেছে। কারণ তিনি চিকিৎসা নিশ্চিত করার এবং রোগ কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজে পেতে লড়াই করছেন।
তিনি বললেন,' আমার মানসিক স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি আগে এমন ছিলাম না। আমি জীবনকে ভালোবাসতাম।'
আবু সবিয়াকা এবং গাজার ক্যান্সার রোগীরা এই রোগকে পরাজিত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদি শিগগিরই ক্রসিং খুলে দেওয়া হয়, তারা বিদেশে দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারবেন।
যুদ্ধবিরতিতে মানুষের চলাচলের জন্য শর্ত থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজা ও মিশরের মধ্যে রাফা সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে রেখেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গাজার সমস্ত সীমান্ত ক্রসিং ত্রাণ প্রবেশ এবং চিকিৎসা স্থানান্তর উভয়ের জন্য উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, বর্তমানে যে হারে সহায়তা স্থানান্তর হচ্ছে, এটি অব্যাহত থাকলে এক দশক বা তারও বেশি সময় লাগবে।
সারহান খান
ইসরায়েলি কারাগারে কয়েক মাস থাকার পর সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি আবু সবিয়াকা আল জাজিরার সঙ্গে তার গল্প শেয়ার করেছেন। যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় ইসরায়েলের তাণ্ডবে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ফিলিস্তিনিরা যে সংগ্রামের মুখোমুখি হচ্ছে, তা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, 'আমি চাই বিশ্ব আমাদের গল্প জানুক।'
প্রায় পাঁচ মাস সারহান খান ইউনিসে ইসরায়েলি আটক থাকার পর তার ভাঙা জীবন পুনর্নির্মাণের জন্য লড়াই করে চলছেন। তিনি বলছিলেন, ইসরায়েলি হেফাজতে থাকাকালীন জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে মারধর, বৈদ্যুতিক শক এবং তার সন্তানদের হত্যার হুমকি সহ্য করতে হয়েছে।
সারহানের জন্য অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয় মে মাসের এক ভোরে - যখন ইসরায়েলি বিশেষ বাহিনী নারীদের ছদ্মবেশে তার স্বামীর সঙ্গে থাকা শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে।
সারহান আল জাজিরাকে বলেন, 'তারা বাড়িটি তছনছ করে। আপনি কোথায় লুকিয়ে আছেন, বন্দীরা কোথায়? এই ধরণের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকে।'
তিনি বলেন, 'তারা আমার বাচ্চাদের একের পর এক ধরে ফেলতে শুরু করে। আসবাবপত্র ভাঙতে থাকে। তারা আমাকে হাতকড়া পরিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে যায়।'
তিনি জানান, ইসরায়েলি বাহিনী তাকে তার ১৩ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে নিয়ে যায় এবং ছোট বাচ্চাদের সামনে তাদের মৃত বাবাকে মেঝেতে ফেলে রেখে যায়।
সারহান বলেন, এরপর তাকে সামরিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা যখন তার স্বামীর যোগাযোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, তখন তাকে মারধর করে।
তাকে বলা হয়েছিল, তার ছেলেকে মুক্তি দেওয়া হবে, কিন্তু তাকে ইসরায়েলের আশকেলন কারাগারে পাঠানো হয়েছিল এবং এক মাস ধরে একটি অন্ধকার নির্জন কক্ষে রাখা হয়।
এই সময় তাকে প্রতিদিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি বলেন, 'তারা এমনকি আমার সন্তানদের হত্যার হুমকি দিয়েছিল, আমাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। তারা বলেছিল যে, আমি আর আমার সন্তানদের দেখতে পাব না।'
মুক্তির পর সারহান এখন অন্যান্য ফিলিস্তিনি বন্দীদের সঙ্গে জীবন পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করছেন। মুক্তিপ্রাপ্ত অনেক ফিলিস্তিনির দেহে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে। যাদের মৃতদেহ ফেরত পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনের চোখ বেঁধে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছে বলে মনে হচ্ছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো জানিয়েছে, বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতনের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
Comments