বারবার আগুন লাগে, তবুও বিমা বিষয়ে উদাসীনতার সংস্কৃতি
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দেশের রপ্তানি খাত বড় ধাক্কা খেয়েছে। পুড়ে গেছে শত কোটি টাকার পণ্য, নষ্ট হয়েছে হাজারো উদ্যোক্তার পরিশ্রমে গড়া স্বপ্ন। কিন্তু আগুনের চেয়েও ভয়ংকর একটি সত্য সামনে এসেছে। জানা গেছে, এই বিশাল স্থাপনার বিমা কভারেজ ছিল মাত্র ২০ লাখ টাকা!
এমন বাস্তবতা কেবল প্রশাসনিক অদক্ষতার নয়, বরং এক গভীর কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পণ্য ওঠানামা করে, সেই কার্গো ভিলেজে এত সামান্য বিমা কভারেজ থাকা রাষ্ট্রীয় দায়হীনতার এক নগ্ন উদাহরণ।
বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) ঘটনাটি তদন্ত করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই তদন্তের আগে এত বছর ধরে বিমা কাভারেজের পরিমাণ অপরিবর্তিত ছিল কেন? কেন তারা নিয়মিত ঝুঁকি মূল্যায়ন করেনি? কেন কার্গো ভিলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে পর্যাপ্ত বিমা সুরক্ষার আওতায় আনা হয়নি?
তদন্তের ঘোষণা দিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর ছাপানো সহজ, কিন্তু প্রকৃত জবাবদিহি নিশ্চিত করা কঠিন।
আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে স্থানীয় বিমা বাধ্যতামূলক। অথচ বহু ব্যবসায়ী খরচ বাঁচাতে বিদেশি বিমা করেন। এটি আইনবিরুদ্ধ হলেও সরকারি সংস্থাগুলোর নীরবতা এই অনিয়মকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। এবার সেই দীর্ঘদিনের 'অদৃশ্য শিথিলতা' আগুন হয়ে ফিরে এসেছে।
যে পরিমাণ আমদানি ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য পুড়েছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। রপ্তানিকারক সমিতি প্রাথমিকভাবে বলেছে, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা। তুলনা করলে দেখা যায় - ২০ লাখ টাকার বিমা ও ১২,০০০ কোটি টাকার ক্ষতির ফারাক কেবল অঙ্কে নয়, এটি একটি অর্থনৈতিক অপরাধের ইঙ্গিত। এই বিপুল ব্যবধান বোঝায়, কতটা দায়িত্বহীনতার মধ্যে আমাদের বাণিজ্যিক অবকাঠামো পরিচালিত হচ্ছে।
এই ঘটনায় বড়ো দায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের। এর সাথে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ড ও কাস্টমস, আইডিআরএ-এর মতো মন্ত্রণালয় ও সংস্থা সমূহও কোনো না কোনোভাবে এই ব্যর্থতার অংশীদার। প্রত্যেকেরই দায়িত্ব ছিল নিশ্চিত করা, এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় যথাযথ বিমা কভারেজ আছে কি না। কিন্তু কেউ তা করেনি।
বাংলাদেশে প্রায় সব দুর্ঘটনার পর একটাই চিত্র দেখা যায়- কমিটি গঠন, তদন্ত, রিপোর্ট জমা, তারপর নীরবতা। কেউ শাস্তি পায় না, কেউ দায় নেয় না।
অর্থনীতিতে বিমা খাতকে এভাবেই বছরের পর বছর উপেক্ষা করা হয়েছে। এই সংস্কৃতি যদি না ভাঙা যায়, তবে ভবিষ্যতের প্রতিটি আগুন কেবল গুদাম নয়, রাষ্ট্রীয় আস্থাকেও পুড়িয়ে দেবে।
বিমানবন্দরের মতো সুরক্ষিত নিরাপত্তা এলাকায় যদি এমন অবহেলা থাকে, তাহলে দেশের শিল্পাঞ্চল বা বন্দরগুলোর অবস্থাই বা কতটা নিরাপদ? এই প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। অথচ এই কার্গো ভিলেজ থেকেই প্রতিদিন রপ্তানি পণ্য পাঠানো হয়, যা দেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস। আমদানিও হয় বিপুল পরিমাণ পণ্য। সুতরাং এই ক্ষতি কেবল একটি স্থাপনার নয়; এটি দেশের অর্থনীতির শিরায় আঘাত।
এই আগুন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই, নিয়ন্ত্রণ আছে কিন্তু তদারকি নেই, দায়িত্ব আছে, জবাবদিহিতা নেই। যতদিন এই বাস্তবতা চলবে, ততদিন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কেবল কথার ফুলঝুড়ি হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্র এখনই চাইলে এই অগ্নিকাণ্ডকে মোড় ঘোরানোর সুযোগে পরিণত করতে পারে।
প্রথমত, বিমা নীতিমালা হালনাগাদ করে বড়ো স্থাপনাগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক ন্যূনতম কভারেজ নির্ধারণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিমা কর্তৃপক্ষের ওপর স্বাধীন নিরীক্ষা ও সংসদীয় নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, বিমা আইন ভঙ্গের জন্য কঠোর আর্থিক জরিমানা ও শাস্তির বিধান কার্যকর করতে হবে।
অন্যথায়, এই অগ্নিকাণ্ডও কেবল 'আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা' হয়ে যাবে।
কার্গো ভিলেজের আগুন নিভে গেছে, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় অবহেলার আগুন এখনো জ্বলছে। এই আগুন নিভবে কেবল তখনই, যখন জবাবদিহিতা ফিরে আসবে দায়িত্বের প্রতিটি স্তরে।
আর সেইদিনই তা হবে- যেদিন রাষ্ট্র বুঝবে, অর্থনীতিকে আগুন থেকে বাঁচাতে কেবল পানি নয়, সাহসও প্রয়োজন।
Comments