সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমাদের সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাক্ষর

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এমন এক নাম, যিনি একাধারে গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, অধ্যাপক ও চিন্তাবিদ - সব ভূমিকাতেই অনন্য। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যে নতুন এক বর্ণনাভঙ্গি, নতুন এক চিন্তার ধারা এনেছেন, যা একই সঙ্গে মানবিক, দার্শনিক ও রাজনৈতিক। তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে একদিকে যেমন গ্রামীণ জীবনের বেদনা, পরম্পরা ও নিঃসঙ্গতা ফুটে ওঠে, অন্যদিকে দেখা যায় শহুরে মধ্যবিত্ত মানুষের ভাঙা স্বপ্ন, উদ্বেগ ও আধুনিকতার সংকট।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জন্ম ১৯৫১ সালে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশের মফস্বল জীবনের সান্নিধ্যে, যা পরবর্তী সময়ে তাঁর গল্প ও উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পরে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। তবে তাঁর প্রধান পরিচয় থেকে যায় একজন লেখক ও চিন্তাশ্রমিক হিসেবে।
তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অনুবাদকের দুঃস্বপ্ন' প্রকাশ হলে পাঠক ও সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তীকালে 'শার্দুলসুন্দরী', 'গল্পসমগ্র', 'জলপাই রঙের অন্ধকার' এবং 'বৃষ্টির শেষে' প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনের নিঃসঙ্গতা এবং সামাজিক বাস্তবতার টানাপোড়েনকে একসঙ্গে বুনে ফেলা যায়। তাঁর গল্পের জগৎ রহস্যময়, কখনও মায়াবী, কখনও রূঢ়ভাবে বাস্তব। বাস্তব ও কল্পনার সীমারেখা তিনি সচেতনভাবে অস্পষ্ট করে দেন, যেন পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেন, কোনটা সত্য, কোনটা প্রতীক।
উপন্যাসেও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গভীর প্রভাব রেখেছেন। 'অবিনাশ চক্রবর্তী গল্প লেখেন' বা 'জীবন ও রাজনীতি'–এর মতো গ্রন্থে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের বৌদ্ধিক সংকট ও সামাজিক বিভাজনকে সাহিত্যের পরিসরে অনুবাদ করেছেন। তাঁর লেখার ভেতরে বারবার ফিরে আসে ইতিহাস ও রাজনীতির প্রতি তীক্ষ্ণ সচেতনতা—কিন্তু তিনি কখনও প্রচারধর্মী হন না। বরং তাঁর ভাষা থাকে সংযত, প্রতীকী ও বহুস্তরীয়।
প্রাবন্ধিক হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অনন্য। তাঁর প্রবন্ধে থাকে সাহিত্য, রাজনীতি, শিক্ষা, ও সংস্কৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের গভীর বিশ্লেষণ। তিনি বিশ্বাস করেন, সাহিত্য শুধু সৌন্দর্যের চর্চা নয়, বরং এটি ন্যায়, স্বাধীনতা ও মানবতার প্রশ্নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাঁর প্রবন্ধ 'সাহিত্য, সমাজ ও রাষ্ট্র', 'কবিতার রাজনীতি', 'অস্তিত্ব ও কল্পনা' বা 'স্মৃতি ও সমকাল'- এসব গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই, তিনি কেবল সাহিত্য সমালোচক নন, বরং একজন দার্শনিক চিন্তাবিদ।
তাঁর লেখার ভাষা সহজ নয়, কিন্তু গভীর। তিনি পাঠককে চ্যালেঞ্জ করেন - বোঝার, ব্যাখ্যা করার, এবং নিজের অবস্থান খুঁজে পাওয়ার জন্য। এই কারণে তিনি মূলধারার জনপ্রিয়তার চেয়ে চিন্তার গভীরতায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অনুবাদক হিসেবেও প্রশংসিত। ইংরেজি থেকে তিনি যেমন বাংলা ভাষায় বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো এনেছেন, তেমনি বাংলার সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর অনুবাদে ভাষার মিতব্যয়িতা ও ছন্দের প্রতি সংবেদনশীলতা লক্ষণীয়।
শিক্ষক হিসেবে তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সাহিত্য ও চিন্তার প্রতি অনুরাগী করে তুলেছেন। তাঁর ক্লাসরুমে সাহিত্য মানে ছিল না কেবল টেক্সট বিশ্লেষণ, বরং জীবনের জটিলতাকে বোঝার এক অন্তর্মুখী যাত্রা। ছাত্রদের অনেকেই পরবর্তীকালে লেখক, গবেষক ও সমাজচিন্তক হয়েছেন, যারা নিজেদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে মনজুরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করেন।
আজকের বাংলাদেশের সাহিত্য যখন একদিকে বাজার ও মিডিয়ার প্রভাবে ক্রমশ পণ্য হয়ে উঠছে, তখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দাঁড়িয়ে আছেন এক নৈতিক অবস্থানে - যেখানে সাহিত্য মানে সত্য অনুসন্ধান, মানে মানুষের ভেতরকার আলোক ও অন্ধকারের মুখোমুখি হওয়া। তিনি মনে করিয়ে দেন, লেখালেখি এক ধরনের দায়বদ্ধতা- নিজের সময়, সমাজ ও মানুষের প্রতি।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শুধু একজন সাহিত্যিক নন; তিনি আমাদের সময়ের এক বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাক্ষর। তাঁর লেখায় যেমন নান্দনিকতা আছে, তেমনি আছে নৈতিক স্পষ্টতা; আছে ইতিহাসের টান, আবার আছে ভবিষ্যতের আহ্বান। তাঁর সাহিত্য আমাদের শেখায়, বাঁচা মানে প্রশ্ন করা, এবং প্রশ্ন করাই মানবতার সবচেয়ে বড় সাহস।
Comments