শারদ অর্ঘ্য

নীলিমায় সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে আর বাতাসে হিমের পরশ বুলিয়ে প্রকৃতি যখন তার রূপ বদলায়, তখনই বোঝা যায় আশ্বিন এসেছে। ভোরের স্নিগ্ধতায় শিউলির মনমাতানো ঘ্রাণ আর শিশিরভেজা ঘাসের ওপর ঝরে পড়া সাদা-কমলা ফুলের রাশি—এই সবই যেন উমার আগমনী সুর। প্রকৃতি তার সবচেয়ে কোমল রূপে সেজে জানিয়ে দিচ্ছে, মা আসছেন।
ঢাকার যান্ত্রিক কোলাহল আর নিত্যদিনের ব্যস্ততার গভীরেও শারদীয় উৎসবের আমেজটুকু স্বতন্ত্র। মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে প্রতিমা সাজানোর শেষ মুহূর্তের তোড়জোড়; শিল্পীর তুলির শেষ টানে মৃন্ময়ী প্রতিমার চোখে ফুটে উঠছে দিব্য আভা। সড়কের ওপর জ্বলে ওঠা রঙিন আলোর মালায় শহরের মনমরা আকাশটাও যেন সেজে উঠেছে, আর বিপণিবিতানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় আর নতুন পোশাকের গন্ধ শৈশবের সেই অমলিন আনন্দের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বাসের দরজা খুলে পুরনো ঢাকার বাতাসে পা রাখতেই একটা চেনা গন্ধ আর স্মৃতির স্রোত রুবিনাকে জাপটে ধরল। কত বছর পেরিয়ে গেছে, তবু এই গলি, এই বাড়িগুলোর দেয়াল যেন তার কৈশোরের সব গল্প সযত্নে আগলে রেখেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, এই গলিতেই করিম চাচার বানানো নাড়ু আর পূজার প্রসাদ এক থালায় মিলেমিশে যেত নির্দ্বিধায়। এখানে ধর্মের অদৃশ্য দেয়ালগুলো ছিল গৌণ, আর উৎসবের রঙ ছিল সার্বজনীন। সেই সুর, সেই সম্প্রীতির আনন্দই যে ছিল পাড়াটার আসল প্রাণ।
স্মৃতির সরণি বেয়ে অবধারিতভাবে মনে পড়ল তার প্রাণের সখী পল্লবীর কথা। পল্লবীদের বাড়ির উঠোনেই বসত বিশাল মণ্ডপ। শৈশবে রুবিনা আর পল্লবী হাতে হাত রেখে সেই মণ্ডপে ঘুরে বেড়াত। সন্ধিপূজার ঐশ্বরিক মুহূর্তে মন্ত্রের অর্থ না বুঝেও তারা একসঙ্গে হাত জোড় করে দাঁড়াত। সে চোখে ছিল কেবল মুগ্ধতা, কোনো বিভেদের ছায়া সেখানে পড়েনি।
আজ এতগুলো বছর পর সেই মণ্ডপের সামনে এসে দাঁড়াল রুবিনা। তবে চেনা আবহের মাঝেও অনেক কিছু অচেনা। একসময়ের বাঁশের ছাউনি আর হাতে আঁকা আলপনার জায়গায় এখন ডিজিটাল ব্যানার, স্পন্সর কোম্পানির বিজ্ঞাপন আর রাজনৈতিক নেতাদের হাসিমুখ। পাড়ার দাদা-দিদিদের স্বতঃস্ফূর্ত হাসির বদলে এখন টিভি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ আর কড়া নিরাপত্তা। পূজার আনন্দের সাথে যেন মিশে আছে এক চাপা সতর্কতা।
মণ্ডপের ভিড়ে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে পল্লবী। পনেরোটা বছর সময়কে ধুয়ে নিয়ে গেলেও চিনতে এক মুহূর্তও ভুল হলো না। চোখাচোখি হতেই দু'জনের মুখে ফুটে উঠল এক অনাবিল হাসি, যা দিয়ে অনায়াসে শৈশবে ফিরে যাওয়া যায়।
"পল্লবী?"
"রুবিনা! তুই?"
ভিড় ঠেলে এক কোণে এসে দাঁড়াল তারা। কিছুক্ষণ নীরবতা, যেন হারিয়ে যাওয়া সময়টাকে ছুঁয়ে দেখল দু'জন। রুবিনাই প্রথম বলল, "মনে আছে তোর? সন্ধিপূজার সময় আমরা কেমন মন্ত্র না বুঝেও ঠাকুরকে ডাকতাম? ধর্ম কী, তা ভাবারও বয়স ছিল না।"
পল্লবী স্মিত হেসে বলল, তখন উৎসব মানেই ছিল এক উঠোনে সবার পাত পড়া। খিচুড়ি, লাবড়া, নাড়ু—সব ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ। এখন মনে হয়, সেই সরল দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল?
রুবিনা চারপাশে তাকাল। জাঁকজমক বেড়েছে, আলো বেড়েছে, কিন্তু মানুষের মুখে যেন এক ধরনের অদৃশ্য অস্থিরতা। "এখন তো সারাক্ষণ একটা ভয় কাজ করে," রুবিনা বলল, "কোথাও কোনো অঘটন ঘটবে না তো? অথচ এই পূজাই তো ছিল আমাদের সম্প্রীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ।"
পল্লবী এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "ভয় আছে, অস্বস্তিও আছে। কিন্তু জানিস, এর মধ্যেও আশার আলোটুকু নেভেনি। আমাদের মুসলমান প্রতিবেশীরাই সবার আগে এসে খোঁজ নেয়, 'প্যান্ডেলের কাজ কতদূর?' এই যে নানা আশঙ্কার মধ্যেও এত মানুষের ভিড়, এটাই আমাদের শক্তি।"
কথা বলতে বলতেই মণ্ডপের ভেতর থেকে বেজে উঠল ঢাকের বাদ্যি। ধুনুচীর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন চত্বরে এক তরুণী অপূর্ব ছন্দে নেচে চলেছে। পরনে তার সাধারণ সালোয়ার-কামিজ, কিন্তু অভিব্যক্তিতে একনিষ্ঠ ভক্তি। রুবিনা অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটি মেহজাবিন, তাদেরই পাশের বাড়ির মুসলিম মেয়ে। ভিড়ের কারও চোখে কোনো প্রশ্ন নেই, বরং সবাই মুগ্ধ হয়ে হাততালি দিচ্ছে। পাশ থেকে এক প্রবীণ মুসলিম ভদ্রলোক সগর্বে বলে উঠলেন, "দেখবেন, আমাদের বউমার নাচই এবার সেরা হবে!"
দৃশ্যটা দেখে রুবিনার বুকের ভেতরটা ভরে গেল। মনে পড়ল তার স্কুলশিক্ষক বাবার কথা। প্রতি বছর পূজায় বাবা মণ্ডপে গিয়ে প্রতিমার সামনে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে আসতেন। একদিন সে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, "বাবা, তুমি তো মুসলমান। পূজায় মোমবাতি জ্বালাও কেন?"
বাবা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, "ধর্ম মানুষকে পরিচয় দিতে পারে, কিন্তু আলো তো সবার। আমি শুধু এইটুকুই প্রার্থনা করি—জগতের সকল প্রাণী যেন ভালো থাকে, শান্তিতে থাকে। এই আলো সেই প্রার্থনারই প্রতীক।"
বাবার সেই কথাগুলো আজও কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক!
কিন্তু বাস্তবতা বড় কঠিন। খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে কোথাও প্রতিমা ভাঙচুর, কোথাও উসকানিমূলক মন্তব্য। রুবিনা ভাবে, এ কোন বাংলাদেশ? যে দেশের ভিত্তি ছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সেখানে কেন উৎসবকে ঘিরে এত আতঙ্ক?
পল্লবী যেন তার মনের কথাটা পড়ে ফেলল। সে রুবিনার হাত ধরে বলল, "ভয় পেলে চলবে না রে। আমাদের শেকড় এই মাটির অনেক গভীরে। মা দুর্গা তো শুধু দেবী নন, তিনি অশুভ শক্তির বিনাশিনী, প্রতিবাদের প্রতীক। অসুর বধের কাহিনী শুধু পৌরাণিক গল্প নয়, এ হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের ডাক।"
তাদের কথার মাঝেই ঘোষণা হলো—প্রসাদ বিতরণ শুরু হয়েছে। মুসলিম-হিন্দু নির্বিশেষে সবাই এক লাইনে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি, লাবড়া আর মিষ্টি নিচ্ছে। প্লাস্টিকের প্লেটে ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি মুখে দিতেই রুবিনার মনে হলো, সে যেন এক মুহূর্তে তার শৈশবে ফিরে গেছে। যত কিছুই বদলে যাক, এই মিলনভোজের স্বাদ বদলায়নি। এটাই তো পূজার আসল আত্মা।
খাওয়া শেষে তারা দেখল, মণ্ডপের এক পাশে সিঁদুরখেলা শুরু হয়েছে। বিবাহিত হিন্দু নারীরা একে অপরের মুখে লাল আবির মেখে দিচ্ছেন। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে একদল তরুণ এগিয়ে এল। তাদের মধ্যে একজন মুসলিম ছেলেও হাসতে হাসতে তার হিন্দু বন্ধুর গালে সিঁদুর মাখিয়ে দিল। হাসির রোল পড়ে গেল চারদিকে।
রুবিনা চোখ বন্ধ করল। ঢাকের শব্দ, ধূপের গন্ধ, ধুনুচীর ধোঁয়া, খিচুড়ির স্বাদ, মানুষের কোলাহল—সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তার মনে হলো, এই তো বাংলাদেশ। যেখানে আজানের সুর আর শঙ্খধ্বনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যেখানে শত বিভেদের চেষ্টার পরেও সম্প্রীতির অদৃশ্য এক বাগান সযত্নে বেঁচে থাকে।
সে মনে মনে উচ্চারণ করল, "মা দুর্গা শুধু মৃন্ময়ী প্রতিমা নন, তিনি আমাদের সামাজিক চেতনার প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি এক থাকি, তবে কোনো অসুরই আমাদের পরাজিত করতে পারবে না।"
মণ্ডপ থেকে বেরোনোর সময় আকাশে শরতের মায়াবী চাঁদ। রুবিনা আর পল্লবী হাতে হাত রেখে হাঁটছে। রুবিনার মনে হলো, রাজনৈতিক আর সামাজিক অস্থিরতা হয়তো সাময়িক, কিন্তু হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা এই সম্প্রীতির বাঁধন এত সহজে ছিঁড়ে যাওয়ার নয়। এই শারদ উৎসব শুধু একটি পূজা নয়, এটি বাঙালির অস্তিত্বের এক চিরন্তন অর্ঘ্য।
Comments