পেটের চর্বি থেকে যেসব রোগ হতে পারে

অনেকেই আছেন যারা পেটের মেদ বা অতিরিক্ত চর্বি নিয়ে ভাবনায় থাকেন। পেটের এই অরিরিক্ত চর্বি সাধারণভাবে 'বেলি ফ্যাট', 'টামি ফ্যাট' বা 'বিয়ার বেলি' নামে পরিচিত। এ থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই যান নিয়মিত ব্যায়াম করতে জিমে যান। তবে এমন মানুষও আছেন যারা এই বিষয়টা নিয়ে ভাবেন না। যার ফলে সময়ের সঙ্গে পেটের চর্বি থেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন।
পেটের চর্বি থেকে যেসব রোগ হয়: বিবিসির এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞরা পেটের অতিরিক্ত চর্বি থেকে যেসব রোগ হয় সে বিষয়ে সচেতন করেছেন। পেটের চর্বি উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত শর্করা ও কোলেস্টেরলের সমস্যার মতো গুরুতর কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এটি টাইপ-টু ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, পেটের চর্বি শরীরে 'সাইটোকাইন' নামের এক ধরনের প্রোটিনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। আর এটাই শরীরে প্রদাহ তৈরি করতে পারে। এছাড়া, বেলি ফ্যাট 'অ্যাঞ্জিওটেনসিন' নামক আরেকটি প্রোটিনের উৎপাদনও বাড়ায়। এই প্রোটিন আবার রক্তনালীকে সংকুচিত করে ও রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি, এই চর্বি থেকে ডিমেনশিয়া, হাঁপানি ও কিছু ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ে।
দিল্লির ফোর্টিস এসকর্টস হাসপাতালের সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট ডা. শিব কুমার চৌধুরী বলেন, পেটে জমে থাকা চর্বি শরীরের অন্য অংশের চর্বির চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। এমনকি যখন পেটের চর্বির কোষ ভেঙ্গে যায়, তখন সেখান থেকে নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান বের হয়। আর এই উপাদানগুলো হৃদপিণ্ডের ধমনীতে প্রদাহ বাড়ায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। এটি শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধও বাড়িয়ে দেয়। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পেটের চর্বি বাড়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন, জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, হরমোনজনিত পরিবর্তন, বয়স, অতিরিক্ত ওজন ও মেনোপজ। এছাড়া, অনিয়মিত জীবনযাপন, অগোছালো রুটিন ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসও এর জন্য দায়ী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষম খাদ্য, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গ্রহণের মাধ্যমে সময়মতো পেটের চর্বি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
পেটের চর্বি কমাতে যা করবেন: পেটের অতিরিক্ত চর্বি কমাতে চিকিৎসকরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে এগুলো হলো:
রাতের খাবার ও ঘুমানোর সময়ের ব্যবধান: রাতে ঘুমানোর দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগে থেকে কিছু খাওয়া যাবে না। কারণ এতে পেতে চর্বি জমে যায়। দিনেবেলা আমরা যেসব যেসব খাবার খাই শরীর সেগুলোর ক্যালরি দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার করে ও শক্তি উৎপাদন করে। কিন্তু রাতের খাবারের পর আর এগুলো ব্যবহৃত হয় না। ফলে সেগুলো সহজেই চর্বি হিসেবে জমে যায় এবং ওজন বাড়তে শুরু করে।
সুষম খাবার: বিশেষজ্ঞরা পেটের চর্বি কমাতে সুষম খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন। যখন খাবারে বেশি ফাইবার থাকলে দীর্ঘ সময় পেট ভরা থাকে। ফাইবারযুক্ত খাবার পাকস্থলীতে দীর্ঘসময় থাকে এবং অন্ত্রে খাবার যাওয়ার গতি ধীর করে দেয়। এতে ক্ষুধা কম লাগে এবং বারবার খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। আর এ কারণেই খাবারে খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন রাখার বিষয়ে সচেতন হতে বলেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রোটিন দীর্ঘসময় পেট ভরা রাখে, ক্ষুধা কমায় এবং ঘ্রেলিন নামক ক্ষুধা বাড়ানো হরমোনের মাত্রা কমায়। প্রোটিন মাংসপেশি শক্তিশালী করে এবং বিপাকক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে, যা ক্যালোরি পোড়ানোর ক্ষমতা বাড়ায়। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ডিম, ডাল, দুধ, পনির, দই, মাছ, মুরগি ও সয়া জাতীয় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রাখা যেতে পারে।
প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া যাবে না: বর্তমানে অনেকেই প্রক্রিয়াজাত খাবার খান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাদা পাউরুটি, চিপস ও ক্র্যাকার্স আর প্রক্রিয়াজাত খাবারে কোনও ফাইবার থাকে না। আর এসব খাবার পেটের চর্বির বাড়িয়ে দেয়। যে কারণে খাবার খুব দ্রুত হজম হয় এতে এবং হঠাৎ রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যায়। এভাবে এগুলো রক্তে শর্করার দ্রুত ওঠানামা ক্ষুধা বৃদ্ধি করে এবং ওজন বাড়ায়। সেইসঙ্গে টাইপ-টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তৈরি করে।
তাই প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে হোল গ্রেইন পাউরুটি, শুকনো তাপে বা ওভেনে বানানো নাশতা, ফল ও বাদামের মতো স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। চিনি ও ক্যালোরি-সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ধূমপান বাদ দিতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম: সুস্থ থাকতে পর্যাপ্ত ঘুম গুরুত্বপূর্ণ। ঘুম কম হলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের ওপর প্রভাব পড়ে যার কারণে, খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ঘুমের ঘাটতি পাকস্থলীতে উৎপন্ন ঘ্রেলিন নামক হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে যাতে ক্ষুধা বেড়ে যায়।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানসিক চাপের কারণে রক্তে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। তাই মানসিক চাপ নেয়া যাবে না ও মানসিক চাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে হবে। এই মানসিক চাপের সময় মানুষ খাবারের প্রতি কম মনোযোগী থাকে এবং মন অন্যদিকে সরাতে অস্বাস্থ্যকর কিছু খেয়ে ফেলে।
শারীরিক পরিশ্রম: ব্যায়াম করলে ও শরীরকে সক্রিয় রাখার ফলে ক্যালরি খরচ হয়। আর এতে করে পেতের অতিরিক্ত
চর্বি কমে। সে কারণে নিয়মিত হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং, সাঁতার বা যোগব্যায়াম করতে হনে। এই অভ্যাস গুলো চর্বি কমানোর পাশাপাশি বিপাকক্রিয়াকেও ত্বরান্বিত করে।
পেটের অতিরিক্ত চর্বি শরীরে নানান জটিল রোগ তৈরি করে। তাই এ ব্যাপারে শুরু থেকেই সচেতন থাকা উচিত। সুস্থ থাকতে খাবারের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে। সমস্যা জটিল মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি। নিজের মতো করে ডায়েট করতে যাবেন না। বরং মেদ কমাতে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন কারণ একেকজন মানুষের শরীরের একেক রকম।
Comments