দহনের দিস্তা: এক দুপুরের উপাখ্যান

নন্দিতা রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তরুণ গবেষক। বয়স সাতাশের কোঠায়, কিন্তু তার দৃষ্টিতে ভর করেছে শহরের যুগপত শ্রান্তি আর দহনের ছায়া।
বর্ষার ক্যালেন্ডার যেন এক তামাশা। যে আকাশে মেঘের ঘনঘটা থাকার কথা, সেখানে কেবলই এক শুষ্ক, নিষ্করুণ অগ্নিবর্ষণ। দ্বিপ্রহরে ঢাকার এই কংক্রিটের অরণ্য এক জ্বলন্ত উনুনে রূপান্তরিত হয়। মৃত্তিকার শুষ্ক দীর্ঘশ্বাস আর বাতাসে ভাসমান শ্বাসরোধী ধূলিকণা মিলেমিশে এক অসহনীয় বাস্তবতা তৈরি করে—এখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসই এক একটি সংগ্রাম।
বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায় নন্দিতা। কপাল বেয়ে গড়িয়ে নামা ঘামের ধারা চিবুক ছুঁয়ে পড়ে। বুকের গভীরে এক অব্যক্ত অস্থিরতার পারদ চড়তে থাকে। কিছুদিন আগে পড়া বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন তার চিন্তার জগতে হাতুড়ির মতো আঘাত করে চলেছে,
'তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলেই মানুষের হতাশা বৃদ্ধি পায় ২৩.৮ শতাংশ, আর উদ্বেগ বাড়ে ৩৭.১ শতাংশ। শীতকালে যেখানে হতাশার হার ১৬.২, গ্রীষ্মে তা অবলীলায় ২০ শতাংশে পৌঁছায়। উদ্বেগও ৮.৩ শতাংশ থেকে লাফিয়ে ১০ শতাংশে দাঁড়ায়'।
এই সংখ্যাগুলো নন্দিতার কাছে নিছক পরিসংখ্যান নয়; এগুলো তার নিজের শরীর ও মনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার এক নির্মোহ ব্যাখ্যা। নিদ্রাহীন রাতগুলো কাটে অবিরাম কাশি আর দমবন্ধ অস্বস্তিতে। সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণি কেবল তপ্ত বাতাসকেই ছড়িয়ে দেয়, ছাদের উত্তাপ যেন সমগ্র সত্তাকে পিষে ফেলতে চায়। মধ্যরাতে ঘামে ভেজা বিছানায় সে নিজের মধ্যেই কুঁকড়ে পড়ে থাকে।
মায়ের কণ্ঠে ঝরে পড়ে উদ্বেগ—
—একজন ডাক্তার দেখা মা, এভাবে শরীরটাকে শেষ করে দিস না।
কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার শক্তিটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই। অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তই যখন এক নিরন্তর লড়াই।
গবেষণার সূত্রে তাকে চষে বেড়াতে হয় এই অগ্নিশহর। রোদের তীব্র দহনে শরীর বিবর্ণ, ধুলোর আস্তরণে শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী। একদিন ক্যাম্পাসে ফিরতেই কানে এলো, সহপাঠী সাদিয়া হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে আসে। এই শহরটা কী তবে এক বিশাল দাহক্ষেত্র?
লাইব্রেরির শীতলতায় বসেও নন্দিতা জরিপের তথ্যে উষ্ণতা অনুভব করে। হতাশা আর উদ্বেগের ক্রমবর্ধমান লেখচিত্রগুলো তার চোখে নিছক রেখা নয়, বরং অগণিত মানুষের নীরব আর্তনাদ—ক্লান্ত শ্রমিক, বিবর্ণ মা, নিদ্রাহীন শিশু। এমন সময় মুঠোফোনে মায়ের বার্তা আসে—
'আজ দুপুরে পাড়ার এক চাচা হিট স্ট্রোকে মারা গেছেন'।
নন্দিতার হাত কাঁপে। মৃত্যু এখানে কতটা সহজ, কতটা দৈনন্দিন!
বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয়। কী ভয়াবহ এক সত্য! কিন্তু এই তথ্যের গভীরে লুকিয়ে থাকা দীর্ঘশ্বাস কি নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছায়?
নন্দিতা নিজেকেও যেন আর চিনতে পারে না। বইয়ের পাতায় ডুব দেওয়া, বা গল্পের ভুবন তৈরি করা ছিল তার আনন্দের উৎস। এখন সামান্য মনোযোগ ধরে রাখাও এক দুঃসাধ্য কাজ। সেদিন অধ্যাপক বলেছিলেন—
—তোমার লেখায় গভীরতা আছে, নন্দিতা। কিন্তু তোমার চোখে রাজ্যের ক্লান্তি।
কথাটা শুনেই অঝোরে কেঁদে ফেলেছিল সে।
গবেষণার প্রয়োজনে শ্যামলীর এক ক্লিনিকে গিয়ে তার পৃথিবীটা যেন আবার দুলে ওঠে। ডিহাইড্রেশনে অচেতন এক কিশোরীর শরীর কাঠ হয়ে গেছে। পাশে তার মায়ের অশ্রুসিক্ত, অসহায় বিলাপ—
—ঘরে তো একটা ফ্রিজও নাই। এক ফোঁটা ঠাণ্ডা পানি ক্যামনে খাওয়ামু?
উন্নয়নের উজ্জ্বল আলোর নিচে চাপা পড়া এই মানুষগুলোর আর্তি নন্দিতার পাঁজর ভেঙে দেয়। এই আগুনের প্রথম শিকার তো তারাই।
সেদিন রাতে সে ডায়েরিতে লেখে—
এই দহন কী কেবল প্রকৃতির, নাকি আমাদের আত্মারও?
অবশেষে নন্দিতা সিদ্ধান্ত নেয়, এই পরিসংখ্যান আর অনুভূতিগুলোকে কেবল গবেষণাপত্রে বন্দী রাখা যাবে না। সে লিখতে শুরু করে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। শিরোনাম দেয়: 'জ্বলে ওঠা দুপুর: বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য, মানসিক বিপর্যয় ও মহাকালের দাবদাহ'।
প্রবন্ধে সে বিশ্বব্যাংকের তথ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর ভুক্তভোগীদের সাক্ষাৎকারের নির্যাস ঢেলে দেয়। সে লেখে—
'২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ যে টানা তাপপ্রবাহের সাক্ষী হয়েছে, গত ৭৬ বছরে তার কোনো নজির নেই। এই অভূতপূর্ব উষ্ণায়ন কেবল মানুষের শরীরকেই নয়, তার মনোজগতকেও এক গভীর সংকট ও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে'।
প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ামাত্রই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কেউ লেখে—'আমার ভেতরের কথাগুলোই আপনি লিখেছেন'। কেউ জানায়, তার সন্তান নিদ্রাহীনতায় ভুগে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়ছে। অবশ্য বিপরীত স্রোতও ছিল—'এসব বাড়িয়ে বলা', 'বাংলাদেশ চিরকালই উষ্ণ দেশ'।
নন্দিতা জানে, মানুষ প্রতিষ্ঠিত সত্যকে সহজে গ্রহণ করতে চায় না। তবু তার মনে হয়, জমাট অন্ধকারে কোথাও যেন এক কিঞ্চিৎ আলোর রেখা দেখা দিয়েছে।
কয়েকদিন পর, বাসে ফিরতে গিয়ে হঠাৎ তার মাথা ঘুরে ওঠে। শরীর বেয়ে নামা ঘামের স্রোতে চেতনা ঝাপসা হয়ে আসে। ঠিক তখনই এক অপরিচিত যাত্রী তার দিকে এক বোতল পানি এগিয়ে দেন। সেই সামান্য জল তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে, কিন্তু একই সাথে জানিয়ে দেয়—তার শরীর আর মনের প্রতিরোধ ক্ষমতা শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।
রাতে মা তাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন—
—'উন্নয়নের দোহাই দিয়ে আমরা কত কী সহ্য করি। কিন্তু এই আগুনে পুড়ে যদি মানুষই না বাঁচে, তবে সে উন্নয়ন কার জন্য?'
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নন্দিতার জানা নেই। তার মনে হয়, গোটা শহর যেন নীরবে এই একই প্রশ্ন করে চলেছে।
পরের সপ্তাহে এক সেমিনারে বক্তৃতা দেয় নন্দিতা। দর্শকাসনে নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক। স্থির কণ্ঠে সে বলে—
'আমরা বলছি হতাশা বেড়েছে ২০ শতাংশ, উদ্বেগ বেড়েছে ১০ শতাংশ। কিন্তু এই সংখ্যার আড়ালে লুকিয়ে আছে একজন শ্রমিকের মৃত্যু, এক কিশোরীর অচেতন শরীর, আর আমার মতো কোনো এক গবেষকের নিঃশব্দ কান্না। পরিসংখ্যানের প্রতিটি বিন্দুর গভীরে একটি করে জীবন আছে'।
পুরো কক্ষে নেমে আসে এক গাঢ় নিস্তব্ধতা। সংখ্যাগুলো যেন প্রাণ পেয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়ায়। সেমিনার শেষে একজন প্রবীণ চিকিৎসক তার কাঁধে হাত রেখে বলেন—
—লিখে যাও। এই আগুন হয়তো আমাদের প্রজন্মে নিভবে না। কিন্তু তোমাদের কণ্ঠস্বরই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পথ তৈরি করবে'।
নন্দিতার চোখ ভিজে ওঠে।
ঢাকার আকাশে আজও আগুন ঝরছে। দহন থামেনি, কমেনি কাশি বা অস্থিরতা। হাসপাতালের ভিড় দীর্ঘতর হচ্ছে, পথেঘাটে বাড়ছে অচেতন মানুষের সংখ্যা। তবু নন্দিতার ভেতরে এক নতুন প্রত্যয়ের আলো জ্বলে উঠেছে।
সে জানে, এই অগ্নিকুণ্ডে টিকে থাকা এক প্রতিদিনের সংগ্রাম। কিন্তু শব্দকে যদি বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার শক্তিকে যদি ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো একদিন এই আগুনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস পাবে।
রাতের নির্জনতায় সে তার ডায়েরির শেষ পাতায় লেখে—
'আমরা এক দহনের শহরে বসবাস করি। কিন্তু শব্দের শিখা যদি অনির্বাণ থাকে, তবে এই ভস্মের ভেতর থেকেই একদিন জীবনের পুনরাবির্ভাব ঘটবে'।
Comments