নীরব নায়কের গল্প — ৯

ছাদের ওপর চাঁদের আলো যেন সাদা পাতার মতো ছড়িয়ে। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের এই ছাদ কখনও নিঃশব্দ হয় না—রাতের আড্ডাগুলো শুধু একটু মৃদু হয়, একটু বেশি অন্তর্মুখী।
রাত পেরিয়ে গেছে দশটা। ধীরে ধীরে ছাদে উঠে আসে রুদ্র। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, চোখে সারাদিনের ক্লান্তি।
এক কোণায় বসে আনিসা—ঢিলেঢালা পাজামা, ভারী ফ্রেমের চশমা, হাতে ছোট্ট নোটবুক। হাওয়ায় তার চুল উড়ছে পাতার মতো।
রুদ্র একটু হাসে।
— তুই এখনো পড়ছিস?
আবেগের চেয়ে অভ্যেসের প্রতিধ্বনি তার কণ্ঠে।
আনিসাও হেসে ফেলে।
— না রে। মাথার ভেতর এত শব্দ জমে গেছে… একটু গুছিয়ে নিচ্ছি। কবিতার একটা ভাবনা।
রুদ্র রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। নিচে শহরের আলো ঝলমল, অথচ তার চোখে অন্য এক আলো—যেটা জ্বলে ভেতর থেকে।
আনিসা হঠাৎ বলে ওঠে—
— তুই কি কখনও ভেবেছিস, আসলে আমরা কী শিখছি?
রুদ্র তাকায়, তারপর ধীরে উত্তর দেয়—
— প্রথমে শেখা শুরু করি শরীর দিয়ে—হাড়, পেশি, রক্ত, স্নায়ু। তারপর আসে রোগ, ওষুধ, আইন, পরিসংখ্যান... কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা যায়, সব ছাপিয়ে মানুষটাই বড় হয়ে ওঠে।
আনিসা মাথা ঝাঁকায় সম্মতির ছায়ায়।
— সেইখানেই তো আসল শিক্ষা শুরু—কীভাবে কারো চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয়, কাঁপা হাত ধরে রাখতে হয় নিশ্চিন্তে। মেডিসিন আর সার্জারি আসবে, কিন্তু আগে আসবে সহানুভূতি।
রুদ্রের কণ্ঠে বাবার পুরনো কথার মতো গম্ভীর দৃঢ়তা।
— আমরা আসলে মানুষ চেনা শিখছি। সেটা বইয়ের পাতায় নয়—এই ছাদে, কারো চোখের গভীরে, কারো নীরবতায়।
আনিসা হাসে—নরম, আত্মবিশ্বাসী।
— তাই তো এই ছাদটাকে এত আপন লাগে। ডাক্তারি শুধু ডিগ্রি না—একটা দায়, এক ধরনের ভালোবাসা।
এই মুহূর্তে কাছে এসে দাঁড়ায় মহিম—চুপচাপ, একটু দ্বিধান্বিত।
রুদ্র তাকে দেখে বলে—
— এই জায়গায় মেডিকেল সায়েন্স শুরু হয় না, মানুষ শেখা শুরু হয়।
রুদ্রের মনে পড়ে তার ভেতরের রায়হানকে—বাবাকে।
যিনি বলতেন,
— ডাক্তার হবি, কিন্তু মানুষ চিনবি আগে। রোগীর হাতে হাত রাখ, ওষুধ পরে দিবি।
ছাদের আরেক প্রান্তে শোনা যায় হাসির শব্দ—শাওন আর সানজিদা।
বন্ধুত্ব, প্রেম, না বলা বোঝাপড়া।
সানজিদা বলে—
— এই কোণাটা আমাদের থেরাপি সেশন। সব বলা লাগে না, শুধু বললেই হালকা লাগে।
রুদ্র চায়ের কাপে চুমুক দেয়। মনে পড়ে, প্রথম অপারেশন রিপোর্ট লেখার আগে বাবাকে ফোন করেছিল।
— ভয় পেয়েছিস?
— হ্যাঁ, একটু।
— ভয় পাস না। তুই তো আমার থেকেও সাহসী।
ছেলেটার নাম মহিম। ছাদে আজ প্রথম এসেছে। মুখে দ্বিধা, চোখে প্রশ্ন।
রুদ্র এগিয়ে গিয়ে বলে—
— এটা শুধু ক্লাসরুম না, একটা পরিবার। এখানে মানুষ শেখে মানুষ হতে।
মহিমের চোখে আলো জ্বলে ওঠে।
হাওয়ায় ভেসে আসে শুকনো পাতা।
জিসান চোখ রেখে পড়ে শোনায়—
— ভবদহে চল্লিশ বছর পানিবন্দি জীবন। হাঁটু পানি পেরিয়ে স্কুলে যায় শিশুরা।
রুদ্র চোখ বন্ধ করে। মনে পড়ে এক কিশোর—ভেজা জামা, মলিন ব্যাগ, চোখে অসম্ভব দৃঢ়তা।
আর পাশে বাবার মতো কেউ বলছে—
— এই পানি একদিন সরবেই। তুই শুধু হেঁটে যা।
ফারহান বলে—
— স্বপ্ন এখন পণ্যের মতো। টাকা থাকলে পাবে, না থাকলে শুধু ধোঁয়া।
সৌম্য যুক্ত করে—
— আমরা এক যুদ্ধে আছি। কেউ পৌঁছায়, কেউ থেমে যায় পথেই।
নীলা উদ্বেগ নিয়ে বলে—
— ৮২% নারী এখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। স্বাস্থ্য মানে শুধু রোগ না—সম্মান আর সচেতনতা।
সবার মুখে নীরবতা, কিন্তু বাতাস আবার বইতে শুরু করে।
রুদ্র জানে, এই রাতের আড্ডাগুলো নিছক গল্প নয়—এগুলো তাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
ছাদ থেকে নিচে তাকায়—নিভে যাওয়া ঘরের আলো, ট্রেনের হুইসেল, নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দ—সব মিলেমিশে এক রূপকথার মতো।
হঠাৎ নরম কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে গায়ে।
রুদ্র ভাবে—
এই ক্লান্তির গল্প একদিন আমরা বদলে দেব। নিজের জন্য নয়—মা-বাবার জন্য, দেশের জন্য।
ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামে সবাই।
পেছনে থেকে যায় আলো-ছায়ায় মেশানো সেই ছাদ—ছড়িয়ে থাকা কিছু স্বপ্ন, কিছু প্রতিজ্ঞা।
আর বুকের ভেতর রয়ে যায় এক অদৃঢ় নয়, অটুট বিশ্বাস—
জীবন মানেই বদলে দেওয়ার গল্প।
Comments