তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের মনস্তত্ত্ব এবং ইতিহাস ধ্বংসের প্রবণতা

যেকোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন কেবল ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটায় না, এটি একটি জটিল মানসিক প্রক্রিয়াও বটে। যখন কোনো দেশের প্রতি তীব্র আকর্ষণ এবং নিজেদের অতীতকে ধ্বংস করে একটি 'নতুন' বর্তমান তৈরির ভুল চেষ্টা। ইন্টারনেট যুগে বেড়ে ওঠা আজকের তরুণ প্রজন্ম এই মানসিক সংকটের মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হয়। আন্দোলনের উত্তেজনার মধ্যে তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে চূড়ান্ত পাওয়া বলে মনে করে, আবার একই সাথে জাতীয় ইতিহাসকে অস্বীকার করার এক ধ্বংসাত্মক ইচ্ছায় তাড়িত হয়।
বিদেশি শক্তির উপর নির্ভরতা: এক ধরনের মানসিক শূন্যতা
মানসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিদেশি শক্তির প্রতি এই নির্ভরতা এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতারই প্রতিচ্ছবি। তরুণ আন্দোলনকারীরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাদের ছবি ছাপা হলেই বা কোনো বিদেশি সংস্থা তাদের পক্ষে বললেই যেন তাদের সংগ্রাম চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে গেল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাইরের সমর্থন কখনোই স্বার্থহীন হয় না। প্রতিটি সমর্থনের আড়ালে রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির স্বার্থ কাজ করে। একটি আন্দোলনের মূল শক্তি যেখানে হওয়া উচিত দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস, সেখানে বাইরের প্রশংসার জন্য আকুলতা মূলত গভীর আত্মবিশ্বাসের অভাবকেই প্রকাশ করে।
ইতিহাস ধ্বংসের মানসিকতা: জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ
আন্দোলনের চরম পর্যায়ে প্রায়ই দেখা যায় যে, তরুণদের রাগ ও প্রতিশোধস্পৃহা ঐতিহাসিক ভবন, মহাফেজখানা (আর্কাইভ) বা দেশের গুরুত্বপূর্ণ দলিলের ওপর আছড়ে পড়ে। সমাজবিজ্ঞানীরা একে 'সম্মিলিত হতাশা' বলে থাকেন, যেখানে বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি জমে থাকা ক্ষোভকে অতীতের বিভিন্ন প্রতীকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু ইতিহাস ধ্বংস করা আর নিজেদের শিকড় উপড়ে ফেলা একই কথা। কারণ ঐতিহাসিক দলিল, ভবন বা মহাফেজখানা কেবল জড়বস্তু নয়, বরং এগুলো একটি জাতির স্মৃতি, পরিচয় এবং দীর্ঘ লড়াইয়ের জীবন্ত প্রমাণ। অতীতকে মুছে ফেলার চেষ্টা প্রকারান্তরে নিজেদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার শামিল।
নেপালের অভিজ্ঞতা: ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার ফল
নেপালের ২০০৬ সালের গণ-আন্দোলনে তরুণ প্রজন্ম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। কিন্তু সেই উত্তেজনার আড়ালে বহু পুরোনো মহাফেজখানা এবং ঐতিহাসিক দলিলপত্র আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পরে নেপালের মানুষ বুঝতে পারে যে, সেদিন ইতিহাস ধ্বংসের মাধ্যমে এক রকমভাবে জাতির আত্মপরিচয়কেই দুর্বল করে দেওয়া হয়েছিল।
২০২৫ সালে এসে নেপাল আবারও সেই ধরনের ক্ষতির শিকার হলো। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত ভক্তপুর দরবার স্কয়ারের কাঠের স্থাপত্য আগুনে ধ্বংস হয়েছে। কাঠমাণ্ডুর আঞ্চলিক মহাফেজখানায় আগুন ছড়িয়ে পড়ায় মল্ল ও শাহ বংশের সময়ের বহু অপূরণীয় দলিলপত্র নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার আবেগে ঘটে যাওয়া এই ক্ষতিগুলো নেপালের ইতিহাসের বুকে একটি নতুন ক্ষত তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: ঐতিহ্যের ওপর বারবার আঘাত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও ঐতিহাসিক দলিল বহুবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। ২০২৫ সালেও বাংলাদেশ ইতিহাস ধ্বংসের এই ধারা থেকে মুক্ত হতে পারেনি:
ধানমন্ডির ৩২ নম্বর: এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কেন্দ্র। এটি ধ্বংস করা হয়েছে। এই বাড়িটি কেবল একটি ভবন নয়, এটি বাঙালি জাতির জেগে ওঠার প্রতীক। এর ওপর প্রতিটি আঘাত ছিল জাতির স্মৃতির ওপর আঘাতের আরেকটি রূপ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মহাফেজখানায় হামলায় এমন অনেক অডিও-ভিজ্যুয়াল নথি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা একাত্তরের রণাঙ্গনের জীবন্ত ইতিহাসকে ধারণ করেছিল।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে মহাফেজখানা: চট্টগ্রামে আন্দোলনের উত্তাপে রেলওয়ের ঐতিহাসিক দলিল সংরক্ষণাগারের একটি অংশ পুড়ে গেছে। সেখানে ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত রেল যোগাযোগের বহু নকশা ও দলিল ছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের মহাফেজখানায় হামলায় বহু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা বাংলা অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতির গবেষণার জন্য অত্যন্ত জরুরি ছিল।
এই ঘটনাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে,ক্ষণিকের আবেগ প্রায়ই ইতিহাসকে শত্রু বানিয়ে ফেলে। কিন্তু এর ফলে যে ক্ষতি হয়,তা একটি জাতির সাংস্কৃতিক ও মানসিক ভিত্তিকে চিরদিনের জন্য দুর্বল করে দেয়।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: একই ভুলের পুনরাবৃত্তি
ইরাক (২০০৩): মার্কিন হামলার পর বাগদাদের জাতীয় জাদুঘর লুট হয়ে যায়। প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস চোখের সামনে বিলীন হয়ে যায়।
সিরিয়া (২০১৫): আইএস জঙ্গিরা প্রাচীন পালমিরা শহর ধ্বংস করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ইতিহাস মুছে দিয়ে নিজেদের চরমপন্থী ভাবনাচিন্তা প্রতিষ্ঠা করা।
আফগানিস্তান (২০০১): তালেবানদের দ্বারা ঐতিহাসিক বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতি এক ভয়ংকর আঘাত।
এই প্রতিটি উদাহরণ আমাদের এটাই দেখায় যে, রাজনৈতিক বা আদর্শগত সংঘাতের প্রথম এবং সবচেয়ে অসহায় শিকার হয় ইতিহাস।
মানসিক বিশ্লেষণ: এই প্রবণতার কারণ কী?
১. পরিচয় সংকট: বর্তমানের ব্যর্থতার দায় অতীতের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতের পথ খোঁজার এক desperate চেষ্টা।
২. প্রতীকী প্রতিশোধ: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে সরাসরি আঘাত করতে না পেরে তাদের আদর্শ বা সময়ের প্রতীকগুলোকে ধ্বংস করা।
৩. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মোহ: দেশের মানুষের সমর্থনের চেয়ে বিদেশি প্রশংসাকে বড় করে দেখা, যা এক ধরনের হীনম্মন্যতার লক্ষণ।
৪. সাময়িক আনন্দ বনাম স্থায়ী ক্ষতি: ইতিহাস ধ্বংসের মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা এক ধরনের তাৎক্ষণিক বিজয় অনুভব করে, কিন্তু এর ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়, তা তারা বুঝতে পারে না।
শেষ কথা
বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভরতা এবং ইতিহাস ধ্বংসের প্রবণতা—এই দুটি বিষয় একটি আরেকটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং উভয়ই একটি জাতির জন্য আত্মঘাতী। নেপাল, বাংলাদেশ বা ইরাকের অভিজ্ঞতা আমাদের একই শিক্ষা দেয়: অতীতকে অস্বীকার করে কখনো স্থায়ী ও শক্তিশালী ভবিষ্যৎ গড়া যায় না।
বাংলাদেশের ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধের দলিল, বা নেপালের দরবার স্কয়ার - এসবই প্রমাণ করে যে ইতিহাস একটি জাতির শক্তির উৎস, দুর্বলতার কারণ নয়। তরুণ প্রজন্ম যদি বাইরের শক্তির ওপর ভরসা না করে নিজেদের জনগণের ওপর বিশ্বাস রাখে এবং ইতিহাসকে ধ্বংস না করে তা থেকে শিক্ষা নেয়, তবেই একটি জাতি সত্যিকারের অর্থে আত্মনির্ভরশীল ও উন্নত হতে পারে। কারণ যে প্রজন্ম নিজের ইতিহাসকে সম্মান করতে জানে না, ভবিষ্যৎও তাকে মনে রাখে না।
Comments