বিদ্রোহী কবি, বিদুষী ছাত্রী ও এক ঐতিহাসিক নিষেধাজ্ঞা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত এক নবীন জ্ঞানতীর্থ। কিন্তু তার প্রাঙ্গণে বিরাজ করছিল এক অদৃশ্য রক্ষণশীল প্রাচীর। বিশ শতকের গোড়ার দিকে সামাজিক অনুশাসনের কঠোর বেষ্টনি নারীশিক্ষার পথকে করেছিল কণ্টকাকীর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুনও ছিল বেশ কড়া। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকা এক অদ্ভুত আইন অনুযায়ী, কোনো ছাত্র ইচ্ছেমতো কোনো ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না—সহপাঠী হলেও প্রক্টরের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতিপত্র নিতে হতো।
এই রকম এক আবহেই ১৯২৭ সালের শীতল ডিসেম্বর মাসে ঘটে যায় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কলকাতা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে ঢাকা সফরে এসেছিলেন বাংলার সাহিত্যাকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তাঁর চোখে তারুণ্যের দীপ্তি, কণ্ঠে অচলায়তন ভাঙার দৃপ্ত উচ্চারণ।
কার্জন হলের স্থাপত্যশৈলী উপভোগ করতে করতে হঠাৎই তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল—সাদা সুতির শাড়ি আর থ্রি-কোয়ার্টার হাতার ব্লাউজ পরিহিতা এক তরুণীর ওপর। সাদামাটা কিন্তু দৃপ্ত সেই উপস্থিতিই যেন প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে এক নীরব ঘোষণা। কবির কৌতূহল জাগল। তিনি বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেন,
— কে এই মহীয়সী?
বন্ধুরা জানালেন, তিনি ফজিলাতুন্নেছা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রথম মুসলিম ছাত্রী।
উত্তর শোনার সাথে সাথে কবির অন্তরে যেন বিদ্যুতের ঝলকানি। এ তো কোনো সাধারণ ছাত্রী নন—এ তো তাঁর কবিতায় স্বপ্ন দেখা মুক্ত নারীর মূর্ত প্রতীক! যিনি লিখেছেন:
নারী আজ সৃষ্টির তরে সর্বনাশী শক্তি নয়, নারী আজ জীবনের মহাশক্তি, মহাজীবনময়।
বন্ধুরা তাঁকে সতর্ক করল, 'এখানে ছাত্র-ছাত্রীর কথা বলা নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে প্রক্টরের শাস্তি নিশ্চিত'। কিন্তু যাঁর নামের সঙ্গেই জুড়ে আছে 'বিদ্রোহী', তিনি কি এমন নিষেধাজ্ঞার শৃঙ্খল মানেন? আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে তিনি এগিয়ে গেলেন সেই তরুণীর দিকে।
— আপনিই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী?
— জি, আমার নাম ফজিলাতুন্নেছা।
— কোন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন?
— গণিত।
— দেশের বাড়ি কোথায়?
— করটিয়া, টাঙ্গাইল।
— ঢাকায় থাকছেন কোথায়?
— সিদ্দিকবাজারে, বোনের বাসায়।
কয়েকটি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়েই রচিত হলো এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত—একদিকে কলম দিয়ে সমাজ বদলের যুদ্ধ চালানো এক দ্রোহী কবি, অন্যদিকে জ্ঞানচর্চার দৃঢ়তায় নারীমুক্তির পথ তৈরি করা এক সাহসী নারী। বিদায়ের আগে কবি মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
— আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই 'ঔদ্ধত্য' সহ্য করতে পারল না। তিন দিন পর, ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে, নোটিশ বোর্ডে ঘোষণা ঝুলল—কাজী নজরুল ইসলামের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ইতিহাস এভাবেই তার কাব্য রচনা করে। যাঁকে একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় বহিষ্কৃত করেছিল, মহাকালের পরিক্রমায় তাকেই করে নিল চিরঅতিথি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, এখানেই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যে শিক্ষাঙ্গন একদিন তাঁর দ্রোহকে ধারণ করতে পারেনি, সেই শিক্ষাঙ্গনই হয়ে রইল তাঁর স্মৃতির চিরস্থায়ী অভিভাবক।
এই ঘটনাটি নিছক একটি নিষেধাজ্ঞা নয়; এটি প্রথাগত অচলায়তনের বিরুদ্ধে এক কবির প্রত্যয় এবং এক নারীর আত্মমর্যাদার যুগপৎ বিজয়গাঁথা।
নজরুল এই প্রতিভাবান তরুণীকে 'সঞ্চিতা' কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। এক চিঠিতে লিখেছিলেন—
'আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রাণী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশ্যে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ 'সঞ্চিতা' আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। এজন্য আলাদা সম্মতি পত্র লইতে হইবে না আশা করি। আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার অন্য কী সম্মান করিব'?
কিন্তু বেগম ফজিলাতুন্নেছা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। আহত নজরুল পরে 'সঞ্চিতা' উৎসর্গ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। গবেষকরা একমত—ফজিলাতুন্নেছার পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্রয় বা আকর্ষণ ছিল না। থাকবেই বা কেন! তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারিণী,আর নজরুল তখন বিবাহিত, সংসারজীবনে আবদ্ধ।
তাঁর এই আবেগের কথা একমাত্র জানতেন নজরুলের বন্ধু এবং ফজিলাতুন্নেছার শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁরই সূত্রে ঢাকায় প্রথম পরিচয় হয়েছিল নজরুল-ফজিলাতুন্নেছার। পরে নজরুল একের পর এক চিঠিতে মোতাহারের কাছে ব্যক্ত করেছেন নিজের অনুভব। প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের যন্ত্রণা ছড়িয়ে আছে সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে।
কাজী মোতাহার হোসেন পরে লিখেছেন—
'ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু'তিন বছরের সময়সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়'।
তবু সেই সময়ে লেখা নজরুলের চিঠি পড়লে বোঝা যায়, তীব্রতাটি কতখানি গভীর ছিল। তিনি লিখেছেন—
'আপনার অন্তত কুশল সংবাদটুকু মাঝে মাঝে জানিতে বড্ড ইচ্ছা করি। যদি দয়া করিয়া দুটি কথায়—শুধু কেমন আছেন লিখিয়া জানান—তাহা হইলে আমি আপনার নিকট চিরঋণী থাকিব। আমার ইহা বিনা অধিকারের দাবি'।
সেই চিঠির প্রতিটি পঙ্ক্তিতে ফুটে ওঠে এক বিনম্র অথচ ব্যথাতুর প্রেমিকের কণ্ঠস্বর—যিনি দূর থেকে শুধু জানতে চান প্রিয়ার সুসংবাদ।
Comments