দারিদ্র্য বাড়লে বাড়ে বৈষম্য

দেশে প্রতি চারজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। অর্থাৎ প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ এখন গরিব। ২০২২ সালে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশে। একই সময়ে চরম দারিদ্র্যের হারও ৫ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। দরিদ্র পরিবারের বড় অংশ আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করছে, যার অধিকাংশই খাবার কেনায় খরচ হয়ে যাচ্ছে। একটি পরিবারের মাসিক খরচের প্রায় ৫৫ শতাংশ খাদ্যে ব্যয় হয়। এছাড়া চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচও দ্রুত বেড়েছে। দারিদ্র্যের বাইরে এখন দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার যেকোনো দুর্যোগে গরিব হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে কর্মজীবীদের ৩৮ শতাংশ পূর্ণ সময় কাজ পান না। নারীদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ এখনো মাত্র এক-চতুর্থাংশের মতো।
এই হলো সারাংশ একটি গবেষণার। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এই গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে গত তিন বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কী বীভৎস চেহারা নিয়েছে। ১৯৭১ এ স্বাধীনতার জন্য যাঁরা সংগ্রাম করলেন,আত্মবলিদান দিলেন, তাঁরা যে শোষণহীন, বৈষম্যহীন এক সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন সফল হওয়া দূরে থাক, আর্থিক বৈষম্য এমন চেহারা নিয়েছে যা তাঁদের দুঃস্বপ্নেরও অতীত। ১৯৯০ এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থ্যানের পরও আবার সেই হতাশা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব, অসহায় মানুষের চোখে জলধারা বইছে, কিন্তু তা নিয়ে ভাবনার কেউ নেই। এক বিরাট সংখ্যক মানুষের অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
পিপিআরসি বলছে, মানুষের প্রধান উদ্বেগ পণ্যের দাম বৃদ্ধি, আয় কমে যাওয়া, চিকিৎসা ব্যয়, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা এবং আগামী দিনের ব্যয়। সামাজিক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্কোন্দল,আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মাদকাসক্তি ইত্যাদি।
জরিপের দিকে চাইলে বোঝা যায় বড় দায় বিগত সরকারের। বিশেষত কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সঠিক আর্থসামাজিক কর্মসূচি সেই সময় নিতে পারেনি। গণতন্ত্রের ঘাটতির কারণে সেই সরকারের জনবিচ্ছিন্নতাও এই ক্ষেত্রে বহুলাংশে দায়ী। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, অন্তর্বর্তী সরকার দারিদ্র্য বাড়ার ঐ ধারাকে আটকাতে পারেনি।
এ বছর এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংকও এক প্রতিবেদনে দারিদ্র্য বৃদ্ধি নিয়ে শংকার কথা প্রকাশ করেছিল। অর্থনীতির হালনাগাদ পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের 'বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট' প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে এ বছর আরও ৩০ লাখ মানুষ 'অতিদরিদ্র' হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শ্লথগতির কারণে ঝুঁকিতে থাকা দরিদ্র মানুষের ওপর বেশি প্রভাব ফেলছে। এতে বৈষম্য আরও বাড়তে পারে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে।
বর্তমান অন্তবর্তী সরকার শুরু থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে সচেষ্ট আছে। কিছুটা সফল হলেও এখনও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান। দেশে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি বাড়ছে না। এতে প্রকৃত আয় কমছে সাধারণ মানুষের। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাসহ অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্লথগতি। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, বিনিয়োগ কোনটিই আশানুরূপ হচ্ছে না। অর্থাৎ অর্থনীতিতে কোন চাঙা ভাব নেই।
বাংলাদেশে উৎপাদন কম হওয়ায় জনগণের আয়ও কমছে যা চাহিদা এবং সঞ্চয়কে সীমিত করছে। কম আয়ের কারণে পণ্যের চাহিদা কম থাকায় বাজারে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণে নতুন কর্মসংস্থানে কোন গতি নেই। আর এসব কারণেই দারিদ্র্যের হার, বিশেস করে চরম দারিদ্র্য হার উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবা যায় যে, দেশে এখন কমপক্ষে পৌনে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদীয় দারিদ্রের দুষ্টচক্রে পড়েছে। দারিদ্র্যের আসল কারণ হচ্ছে বৈষম্য। এই বৈষম্যই দারিদ্র্য সৃষ্টি করছে ও করেছে। বৈষম্য কেবল আয়গত পার্থক্য থেকেই গড়ে ওঠে না, এর সঙ্গে একটা বড় সংযোগ আছে স্বাস্থ্যের সুযোগ সংক্রান্ত বঞ্চনা ও বৈষম্যের। পিপিআরসি গবেষণা বলছে, ৫১ শতাংশ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী অসুখে ভুগছেন। দেশে জীবনযাত্রার মান উন্নততর হয়েছে, কিন্তু সুবিধাভোগী ও সুযোগবঞ্চিতদের বিভাজন ক্রমবর্ধমান।
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে, তাতে এই বৈষম্য আত্মঘাতী। দেশ বর্তমানে যে মন্দা পরিস্থিতির সম্মুখীন,তার মূল কারণ চাহিদার অভাব। ক্রমবর্ধমান আর্থ-সামাজিক বৈষম্য চাহিদার অভাবকে তীব্রতর করছে। সমান পরিমাণ আয় বা সম্পদ বাড়লে ধনীর তুলনায় দরিদ্র মানুষের ভোগব্যয় অনেক বেশি অনুপাতে বাড়ে। অর্থাৎ, কতিপয় অতিধনীর হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হবার পরিবর্তে যদি অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে সেই সম্পদ বণ্টিত হত, তবে দেশে সার্বিক ভোগব্যয়ের পরিমাণ বাড়ত। চাহিদাও বাড়ত। অতিধনীদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হলে বিনিয়োগের হার বাড়ে, সেটাও দেখা যাচ্ছে না। আসলে বাজারে চাহিদা না থাকলে, পুঁজিপতিদের হাতে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তারা লগ্নি করেন না।
সম্পদ বণ্টনে প্রবল বৈষম্য থাকলে স্বভাবতই সিঁড়ির নীচের ধাপে থাকা জনগোষ্ঠী স্বক্ষমতা অর্জন করতে ব্যর্থ হবে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চাওয়া জুলাইয়ের বাংলাদেশে এ অবস্থা অসহ্য। বাংলাদেশে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তার দায় মূলত সরকারের, বাজারের নয়। বাজারকে আপন ধর্মে অবিচলিত থাকতে দিলে বহুতর মানুষের নিকট স্বাভাবিক ভাবেই উন্নয়নের সুফল পৌঁছায়। প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি না করলে, দখল আর চাঁদাবাজি সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিলে এমন বৈষম্য হবেই। সেটা ঘটেছে এবং এখন তা সংশোধনের দায়িত্বও রাষ্ট্রেরই।
লেখক : সাংবাদিক
Comments