সাংবাদিকতা দরিদ্র পেশা, তবুও ভালো থাকা যায় কেমন করে?

কলাম লিখে জনপ্রিয় হয়েছিলেন সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। কলাম লিখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। জীবনের শেষ লেখায় তো আর সব বলা যায় না, কিন্তু যেটুকু বলে গেছেন তা এ দেশের সাংবাদিকতাকে সবার কাছে উন্মোচিত করে গেছেন নতুন করে। কতটা দারিদ্র্য, কতটা অসম্মান, কতটা হতাশা একটা পেশায় থাকতে পারে তার কিছুটা বলে গেছেন তিনি।
অনেকেই তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে সমালোচনা করছেন, অনেকেই সহানুভূতি জানাচ্ছেন তাঁর পরিবারের প্রতি, অনেকেই সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা এখন সত্যিকার অর্থে কোন পেশা নয়। বেতন কম এবং অনিয়মিত, চাকুরির কোনো নিশ্চয়তা নেই। অন্য কোন প্রকার সুবিধা তো নেই-ই। সাংবাদিকতা নিয়ে গোটা দেশ জুড়েই নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। কিন্তু এদেশে যারা সাংবাদিকতার নৈতিকতা, সাংবাদিকের পেশাদারি কর্তব্য নিয়ে কথা বলেন তারা বাস্তবতা না জেনে অনেক সময়ই সাংবাদিক সমাজকে নানা অপবাদ দেন। বিভুরঞ্জন সরকারের লেখা থেকে অনেকেই আজ বুঝতে পারছেন সৎ ভাবে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করা এই বাংলাদেশে কতটা কঠিন।
কেউ গভীরে গিয়ে দেখছে না যে, কেন পেশাটা আজ অ-পেশা হয়ে গেল। আইন ছিল, ওয়েজ বোর্ডে শুধু ভালো বেতনের কথাই ছিল না, ছিল করমুক্ত বেতন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ডাবল গ্র্যাচুইটি, পুরো পরিবারের চিকিৎসা সুবিধা, রিক্রিয়েশন লিভ, পোশাক ভাতাসহ কত কিছু! সব আজ নির্বাসিত। আইন নেই, মালিকের ইচ্ছা অনিচ্ছাই সংবাদ মাধ্যমে সব। ওয়েজ বোর্ড শুধু পত্রিকার জন্য নাম কা ওয়াস্তে আছে, কিন্তু তার নবায়ন নেই বহু বছর। অনেক কাগজ পুরোনো ওয়েজ বোর্ডও দিচ্ছে না। টেলিভিশন আর অন লাইন চলছে যেমন খুশি তেমন করে।
গুটি কয়েক মালিক ও রাষ্ট্র ঘনিষ্ট সাংবাদিকের চকচকে জীবন দেখে এই পেশার অন্দরমহল সম্পর্কে কোন ধারণাই পাওয়া যায় না। তার কিছুটা অবশ্য বিভুরঞ্জন বলে গেছেন। সাংবাদিকের আর্থিক অনটনের কথা তবুও উঠছে, কিন্তু সাংবাদিকতাই যে দেশে সেভাবে হচ্ছে না সে আলোচনা নেই কোথাও। দেশে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ আর বিভাজনের যে চর্চা বিকশিত হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে তার বড় শিকার সাংবাদিক সমাজ। কিন্তু সে নিয়ে তাদের মধ্যেও বিকার কম, কারণ এই বিদ্বেষ আর সহিংসতা চর্চা এখন গণমাধ্যম নামক জগতেরও সংস্কৃতি।
রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় এ অবস্থার অবসান সহসা হবে না। সাংবাদিকতাও করে যেতে হবে। সব সাংবাদিক দুর্নীতি করবে না, সবাই সহিংসতার চর্চাও করবে না। যারা করছে তারা আগেও করেছে, এখনও করছে এবং তারা এই পেশাকে বিক্রি করে পদ পদবী দখল অব্যাহত রেখেছে।
বিভুদা'র অনেক অভাব ছিল। হয়তো অভাববোধ তার চেয়ে বেশি ছিল। প্রশ্ন হলো দুর্নীতি না করে, লোভে জীবন ভাসিয়ে না দিয়ে, সরকারি বা কর্পোরেট, বা রাজনৈতিক সুবিধা না নিয়েও কেমন করে একজন সাংবাদিক ভাল থাকতে পারেন সেই আলোচনাটা প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের জন্য যারা আসলে সাংবাদিকতটা তবুও করতে চান।
পরের কথাগুলো তাদের জন্য যারা সৎ থেকেও ভালো সাংবাদিক হতে চান, ভালো থাকতে চান।
বাংলাদেশের মতো দেশে সাংবাদিকতা পেশা খুব লাভজনক নয়। বিশেষ করে যাঁরা প্রথাগত অর্থে জনপ্রিয় বা কর্পোরেটপন্থী নন, তাঁদের আয় সীমিত থাকে। ফলে অনেক সাংবাদিক অর্থের টানে নানা রকম অস্বচ্ছ পথে হাঁটতে বাধ্য হন। কিন্তু একজন সাংবাদিক যদি সংকল্প করেন যে, তিনি দুর্নীতি করবেন না, তবুও সম্মানের সাথে বাঁচা সম্ভব।
কীভাবে?
১. জীবনযাত্রার সরলীকরণ:
সততা ধরে রাখতে চাইলে জীবনযাপনকেও সরল করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, দামী বস্তুর মোহ, বিলাসী শখ - এসব এড়িয়ে চলা জরুরি। বাসা, খাবার, পোশাক - সবকিছুতেই সাদামাটা জীবন বেছে নিতে পারলে সীমিত আয়ে শান্তিতে থাকা যায়।
২. বিকল্প আয়ের সুযোগ তৈরি:
সাংবাদিকতার বেতনের বাইরে কিছু বাড়তি আয়ের পথ খুঁজে রাখা দরকার।
যেমন - লেখালেখি: কলাম, ব্লগ, বা বই লেখা বা সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্ট তৈরি করা।
শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষণ: সাংবাদিকতা বা লেখালেখির প্রশিক্ষণ দেওয়া।
ফ্রিল্যান্স কাজ: অনুবাদ, কনটেন্ট রাইটিং, গবেষণা সহায়তা।
এসব কাজ সাংবাদিকতার সততার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং আপনাকে আরও শক্তিশালী করবে।
৩. সততার সুনামকে সম্পদে পরিণত করা:
দুর্নীতি না করে হয়তো টাকা কম আসবে, কিন্তু ধীরে ধীরে পরিচিতি গড়ে উঠবে একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে। দীর্ঘমেয়াদে এই সুনামই এনে দেবে সম্মান, পাঠকের আস্থা, এবং বিশেষ কাজের সুযোগ।
৪. অভাববোধ নয়, ছোট ছোট আনন্দকে মূল্য দেওয়া:
অল্প টাকায়ও সুখী হওয়া যায় - যদি তা খুঁজে নিতে পারেন। এক কাপ চায়ের আড্ডা,পরিবারের সঙ্গে সময়,পাঠকের একটি ধন্যবাদ - এসবই জীবনের সত্যিকারের প্রাপ্তি। বড় বড় বিলাসিতা না থাকলেও এভাবে মন ভরে থাকে।
৫. সহযোদ্ধা খুঁজে নেওয়া:
সৎ মানুষরা অনেক সময় একা হয়ে যান। তাই যাঁরা একই পথে আছেন,তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলে মানসিক শক্তি বাড়ে এবং একে অপরকে সহায়তা করার সুযোগ মেলে।
৬. আত্মমর্যাদাকে প্রাধান্য দেয়া:
সাংবাদিকতা কেবল চাকরি নয়, এটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই চেতনা থেকেই শক্তি আসে। এই আত্মমর্যাদা এবং মনের শক্তিই টিকিয়ে রাখবে। এতে হয়তো অর্থ কম আসবে,কিন্তু জীবনের মান কমবে না। বরং আপনি সম্মানের সঙ্গে বাঁচবেন এবং সেটিই আসল জয়।
Comments