বিভুরঞ্জনকে নিয়ে তসলিমা নাসরিনের ফেসবুক পোস্ট

বেঁচে থাকার অধিকার মানুষের যতটুকু আছে, ততটুকুই আছে মরে যাওয়ার অধিকার। সকালে বিভুরঞ্জন সরকারের নিখোঁজের খবর শুনে খুবই উদবিগ্ন ছিলাম। সরকারের সন্ত্রাসী বাহিনী বিভুরঞ্জনকে হয়তো মেরে ফেলেছে, এইরকম আশঙ্কা করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। তখন একজন বিডিনিউজে ছাপা হওয়া বিভুরঞ্জনের ''শেষ লেখা''টির লিঙ্ক আমাকে দিল। ভোর ৫টায় লেখা তাঁর 'শেষ লেখা'টি পড়ার পর আমি তাঁর নিখোঁজ নিয়ে আশঙ্কা করা পোস্টটি ডিলিট করি। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর লাশ মেঘনা নদীতে পাওয়া গেছে এমন খবরও আসে। আমি তখন বিভুরঞ্জনকে নিয়ে নতুন একটি পোস্ট দিই, যেখানে উল্লেখ করি তাঁর হতাশার কথা। তাঁর চরম হতাশার কথা আমি জানতাম।
ফেসবুকের মেসেঞ্জারে পূর্ব পরিচিত হিসেবে আমাদের মাঝে মাঝে মত বিনিময় হতো। তিনি যতদিনই মেসেজ করেছেন, নিজের কী হয়নি, অন্যদের কত কিছু হয়েছে, নিজে কী পাননি, অন্যরা কত কিছু পেয়েছে, তাঁর অর্থকষ্ট, তিনি কতভাবে বঞ্চিত, এসব নিয়ে হতাশাই ব্যক্ত করতেন। আমার খুব মায়া হতো। তাঁকে চিয়ার আপ করার জন্য বলতাম কী পাননি তা-ই শুধু ভাবছেন, কী পেয়েছেন, তা নিয়েও ভাবুন। আপনার দুই ছেলে মেয়ের একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার। এত হতাশায় ডুবে থাকা আপনাকে মানায় না। অর্থকষ্ট নিশ্চয় ঘুচবে।
বিভুরঞ্জনের হতাশার সঙ্গে তাঁর সার্বিক অবস্থার আমি খুব সামঞ্জস্য খুঁজে পেতাম না। মনে হতো বাস্তবে যতটা না তিনি অসহায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অসহায়ত্ব তিনি বোধ করছেন। তাঁর যত না অভাব, তার চেয়েও বেশি অভাববোধ। যত না অর্থহীন তাঁর জীবন, তার চেয়েও বেশি অর্থহীন ভাবছেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কি দারিদ্র কম দেখেছি, নাকি দারিদ্রে কম ভুগেছি? বিভুরঞ্জন বস্তিতে বাস করতেন না, তিনি না খেয়েও থাকতেন না। ডাক্তার মেয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশান পরীক্ষায় ফেল করেছেন বলেও তিনি দুঃখ করেছেন। তিনি মনে করছেন তাকে পরীক্ষায় ফেল করানো হয়েছে। হয়তো হয়েছে।
তবে সবার জানার জন্য বলছি, ডাক্তারি বিদ্যায় ফেল করা অত্যন্ত ভাল ছাত্র ছাত্রীদের জন্যও খুব স্বাভাবিক। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীই ফেল করে। বর্ষে বর্ষে ফেল না করে এক চান্সে ডাক্তারি পাশ করা, সে আণ্ডার গ্রাজুয়েট হোক, পোস্ট গ্রাজুয়েট হোক, খুবই রেয়ার।
বিভুরঞ্জনের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হতো, তাঁর হতাশা সাধারণ মানুষের হতাশার মতো নয়, তার চেয়েও অতিরিক্ত। হয়তো তাঁর ডিপ্রেশান ডিসঅর্ডার ছিল। অর্ডারের বা স্বাভাবিকতার বাইরে ছিল সেই ডিপ্রেশান। কিছু ঝগড়া, কিছু লড়াই, কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা হয়তো ট্রিগার করেছে, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জীবনের শেষ চিঠি লিখতে এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মেঘনায় ঝাঁপ দিতে। খুব অভাবী মানুষেরা আত্মহত্যা করে, এরকম ভাবা ভুল। হলিউডের তারকা রবিন উইলিয়ামের ধন সম্পদ যশ খ্যাতি স্বজন বন্ধু ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষী অঢেল থাকা সত্ত্বেও তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তিনিও অস্বাভাবিক হতাশা রোগে ভুগতেন।
বিভুরঞ্জনের 'শেষ লেখা' পড়ার পরও কিছু লোক দাবি করছে বিভুরঞ্জনকে খুন করা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, এই দাবির পেছনে তাদের রাজনৈতিক কোনও উদ্দেশ্য আছে। সব দিক দেখে শুনে আমার মনে হয়না বিভুরঞ্জন খুন হয়েছেন। এই সরকারের সন্ত্রাসী এবং জিহাদী বাহিনী হামেশাই মানুষ খুন করছে। খুন করা তাদের কাছে ডাল ভাত। কিন্তু বিভুরঞ্জনের হতাশায় নিমজ্জিত চিঠি অন্য কথা বলে, বলে বিভুরঞ্জন নিজেই নিজেকে খুন করেছেন।
জীবন বিভুরঞ্জনের। তিনি যদি এই জীবনটির সমাপ্তি চান, আমরা বাধা দেওয়ার কে? আমরা তাঁকে স্মরণ করবো আশি-নব্বই দশকের একজন তুখোড় সাংবাদিক হিসেবে।
Comments