রাষ্ট্রনেতাদের নিরাপত্তা, আলাস্কায় যা দেখালেন পুতিন

রাষ্ট্রপ্রধানদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা কোনো সাম্প্রতিক বিষয় নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সবচেয়ে শক্তিশালী রাজপ্রাসাদ, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি বা শত শত প্রহরিও অনেক সময় নেতাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ নিরাপত্তা শুধু বাহ্যিক ব্যবস্থা নয়, এটি ব্যক্তিগত অভ্যাস, আস্থা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সতর্কতার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
আলাস্কা শীর্ষ বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে ব্যক্তিগত সতর্কতা প্রদর্শন করেছেন, তা বিশ্বকে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে -রাষ্ট্রপ্রধানের জীবন কেবল একজন ব্যক্তির নয়, একটি জাতির ভাগ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বহু উদাহরণ আছে যেখানে সতর্কতার অভাব ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে। আবার ব্যক্তিগত সচেতনতা অনেক সময় প্রাণ রক্ষা করেছে।
১. আলাস্কা বৈঠক ও পুতিনের দৃষ্টান্ত:
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যেমন প্রভাবশালী, তেমনি নিরাপত্তা বিষয়ে সতর্কতার জন্যও পরিচিত। আলাস্কা বৈঠকে তাঁর সীমিত যোগাযোগ,অঙ্গভঙ্গি ও জনসমাগমে সতর্কতা একবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
নিরাপত্তা বাহিনী সবসময় তাঁকে ঘিরে রাখলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছু অভ্যাস গড়ে তুলেছেন যা তাঁর জীবনকে সুরক্ষিত রাখে। যেমন -
* খাবার গ্রহণে বিশেষজ্ঞ দলের তদারকি।
* গাড়ির রুট হঠাৎ পরিবর্তন।
* জনসভায় নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা।
* অপ্রয়োজনীয় ঘনিষ্ঠতা এড়িয়ে চলা।
এই অভ্যাসগুলো পুতিনকে শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধান নয়,বরং নিরাপত্তাবান্ধব নেতা হিসেবে আলাদা পরিচিতি দিয়েছে।
২. রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বনাম ব্যক্তিগত সতর্কতা:
প্রশ্ন জাগে - রাষ্ট্রপ্রধানদের চারপাশে এত কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন ব্যক্তিগত সতর্কতা জরুরি? উত্তর পাওয়া যায় ইতিহাস থেকে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যতো শক্তিশালীই হোক না কেন,তা সবসময় সীমাবদ্ধ। ষড়যন্ত্রকারীরা নিরাপত্তার দুর্বলতা খুঁজে নেয়। আবার নেতার নিজের আচরণ - অতিরিক্ত আস্থা,আবেগ বা অসতর্কতা-শত্রুকে সুযোগ করে দেয়। তাই রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা দ্বিমুখী:
১. প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা।
২. ব্যক্তিগত সচেতনতা।
যেখানে দ্বিতীয়টি উপেক্ষিত হয়,সেখানে ইতিহাস রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
তিনটি দৃষ্টান্তে বিষয়গুলো কিছুটা বোঝা যাবে।
১. অনেক রাষ্ট্রনায়কই এসব মনে চলেন না যেমনটা চলতেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এটি শুধু একটি পরিবারের নয়,গোটা জাতির জন্য ভয়াবহ ট্র্যাজেডি।
ঐতিহাসিক সূত্র বলছে,বঙ্গবন্ধুকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁকে জানিয়েছিল নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেসব সতর্কবার্তাকে গুরুত্ব দেননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল - যে জাতির জন্য তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন,সেই জাতির মানুষ তাঁর ক্ষতি করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল তাঁর নিজস্ব আস্থার বৃত্ত।
২. ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হ্যাঁ,অনেক ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে ইন্দিরা গান্ধী তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট অবহেলা করেছিলেন। বিশেষ করে ১৯৮৪ সালে শিখদের স্বর্ণ মন্দিরে র অপারেশন ব্লু স্টার-এর পর থেকে তিনি শিখ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন। তবু তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা পরামর্শ উপেক্ষা করেছিলেন।
যেমন -
শিখ দেহরক্ষী রাখা – নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাকে পরামর্শ দিয়েছিল শিখ দেহরক্ষীদের দায়িত্ব থেকে সরাতে। কারণ,ওই সময়ে অনেক শিখ অসন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী মনে করেছিলেন শিখ দেহরক্ষী বাদ দিলে তা শিখ সম্প্রদায়ের প্রতি অবিশ্বাসের প্রকাশ হবে। তাই তিনি তাদের দায়িত্বে রাখেন। শেষ পর্যন্ত তার শিখ দেহরক্ষীর হাতেই তিনি নিহত হন।
অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়া – প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি খুব সহজভাবে চলাফেরা করতেন। অনেক সময় নিরাপত্তা বলয়ের কঠোর নিয়ম মেনে চলতেন না। তিনি মনে করতেন অতিরিক্ত নিরাপত্তা জনসাধারণ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দেয়।
রাজনৈতিক ইমেজকে অগ্রাধিকার দেওয়া – তার ভাবমূর্তিতে "জনগণের নেত্রী" হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকার ইচ্ছে ছিল। এজন্য তিনি কখনও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে রাজি হননি, যদিও আশেপাশে হুমকি বাস্তব ছিল।
অতএব বলা যায়,ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক বার্তা ও ভাবমূর্তির কারণে নিরাপত্তার বিষয়ে অতি সতর্ক ছিলেন না,বরং অনেকটা অবহেলা করেছিলেন। আর সেই অবহেলাই শেষ পর্যন্ত তার হত্যার পথ সহজ করে দেয়।
৩. ভারতের আরেক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ছিলেন জনমানুষের কাছে সহজপ্রবেশ্য নেতা। জনগণের ভিড়ে থাকা তাঁর রাজনৈতিক কৌশল ছিল। কিন্তু এই সহজপ্রবেশ্যতাই তাঁর সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯১ সালে শ্রীপেরাম্বদুরে নির্বাচনী সমাবেশে তিনি আত্মঘাতী হামলার শিকার হন। ভারতীয় গোয়েন্দারা তাঁকে সতর্ক করেছিলেন,কিন্তু তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাননি।
এখানে ব্যক্তিগত আবেগ প্রাধান্য পেয়েছিল নিরাপত্তার ওপর। আর তার ফল হয়েছিল মর্মান্তিক। রাজীব গান্ধীর মৃত্যু প্রমাণ করে -জনপ্রিয়তা কখনোই নিরাপত্তার বিকল্প নয়।
বিশ্ব ইতিহাসের শিক্ষা:
বিশ্ব ইতিহাসে একই শিক্ষা বারবার ফিরে এসেছে।
* আব্রাহাম লিংকন: থিয়েটারে সাধারণভাবে গিয়েছিলেন। সতর্কতা উপেক্ষা করেছিলেন। আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
* জন এফ. কেনেডি: খোলা গাড়িতে জনগণের কাছে যেতে চেয়েছিলেন। নিরাপত্তার পরামর্শ মানেননি। প্রাণ হারান।
* বেনজির ভুট্টো: পাকিস্তানে জনসভায় উন্মুক্ত গাড়িতে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছিলেন। সেখানেই হামলার শিকার হয়ে নিহত হন।
সব উদাহরণই দেখায় -প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা ব্যর্থ হতে পারে,কিন্তু ব্যক্তিগত সতর্কতা অনেক সময় জীবন বাঁচাতে পারত।
পুতিন যে বার্তা দিলেন -
পুতিন তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বহুবার হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন। সেসব অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও সতর্ক করেছে। তিনি ব্যক্তিগত অভ্যাসের মধ্যে নিরাপত্তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। আলাস্কা বৈঠকে তাঁর উপস্থিতি যেন এক নীরব বার্তা – "রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা শুধু প্রহরীদের দায়িত্ব নয়,এটি তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্ত,প্রতিটি অভ্যাসের মধ্যেও নিহিত।"
Comments