স্মরণে কবি শামসুর রাহমান

"স্বাধীনতা তুমি/ বাগানের ঘর, কোকিলের গান/ বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা/ যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।" বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গভীর থেকে উঠে আসা স্বাধীনতার এক সর্বজনীন ইশতেহার যেন লিখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান।
আজ কবির প্রয়াণ দিবস। কিন্তু কোথায় সেই কোকিলের গান? কোথায় সেই যেমন ইচ্ছে লেখার কবিতার খাতা? বহুবিধ কারণে আজ কোকিল বিষণ্ণ,বটের ঝিলিমিলি পাতা বিবর্ণ, আর কবিতার খাতায় শকুনের দৃষ্টি।
শামসুর রাহমান সেভাবে কখনও সাহস প্রদর্শন করেন নি। কথা বলতেন খুব কম। খুবই নম্র স্বভাবের ছিলেন। কিন্তু তিনিই বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন,গণ-অভ্যুত্থান,সত্তরের নির্বাচন,একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ,বঙ্গবন্দূর নির্মম হত্যাকাণ্ড,সামরিক শাসনের যাতাকল,স্বৈরাচারী শাসন,গণতান্ত্রিক আন্দোলন,মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ-সাম্প্রদায়িকতা,প্রজন্মের জন্য পরিশুদ্ধ বাংলাদেশ ইত্যাদি বিষয়ে স্মরণীয় কবিতাগুলো লিখে গেছেন।
কবি শামসুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁকে বলা হয় "স্বাধীনতার কবি" বা "আলোকের কবি"। তাঁর কাব্যভাষায় আধুনিকতার সঙ্গে গভীর মানবিকতা ও সমাজচেতনা মিলেমিশে আছে।
জীবন ও কর্ম
শামসুর রহমান ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। পেশাজীবনে তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্য সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। কাজ করেছেন আরও অনেক দৈনিকে।
সাহিত্যিক অবদান
তাঁর কবিতা ১৯৫০-এর দশক থেকে বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা তৈরি করে। ভাষার সরলতা, ছন্দের আধুনিকতা এবং মানবজীবনের গভীর অনুভূতি তাঁর কবিতাকে সাধারণ পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রথম গান,দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে" ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত কবিতা "স্বাধীনতার কবিতা", "তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা" তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা এনে দেয়। ষাট,সত্তর ও আশির দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা,গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তাঁর কবিতায় প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
কবিতার বৈশিষ্ট্য:
সহজ-সরল অথচ হৃদয়গ্রাহী ভাষা।
শহুরে জীবনের অভিজ্ঞতা ও মধ্যবিত্ত মানুষের দুঃখ-আনন্দ।
মুক্তচেতা মনন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার প্রতি গভীর দায়বদ্ধতা।
প্রেম ও প্রকৃতির কাব্যময় রূপ।
উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ:
প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
রৌদ্র করোটিতে
বিধ্বস্ত নীলিমা
বন্দী শিবির থেকে
নিরুদ্দেশে যাত্রা
দুঃখক্লান্ত নক্ষত্র
পুরস্কার ও সম্মাননা:
তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা লাভ করেছেন।
২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় তিনি পরলোকগমন করেন।
শামসুর রহমান বাংলা কবিতাকে নাগরিক জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মানবতার চেতনায় ভরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কবিতা আজও বাংলাদেশের সাহিত্যপ্রেমীদের অনুপ্রেরণার উৎস।
Comments