পেশা বদলায়, সমাজও বদলায়

সময় বদলায়, মানুষ বদলায়—আর তার সঙ্গে বদলায় পেশার ধরন, জীবিকার সংজ্ঞা এবং সমাজের কাঠামো।
এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ পেশাগুলো আজ শুধুই অতীতের গল্প। অন্যদিকে, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে নতুন ধরনের পেশা—যেগুলো কেবল কর্মক্ষেত্র নয়, বদলে দিচ্ছে চিন্তা, পরিচয় ও পারস্পরিক সম্পর্কের রূপ।
হারিয়ে যাওয়া পেশা: স্মৃতির আড়ালে সমাজের এক অধ্যায়
■ পালকি বাহক
সম্ভ্রান্ত নারীদের চলাচলে একসময় অপরিহার্য ছিল পালকি। বিয়ে বা উৎসবে এই বাহন বহন করতেন পালকি বাহকেরা। আজ তারা শুধুই ছবিতে দেখা যায়।
■ ধুনরি বা তুলা ধুননকারী
শীতে গ্রামে ডাক পড়ত—"ধুনরি আইছে!" তুলা ধুনে লেপ-তোষক বানানোর পেশাটি এখন বিলুপ্তপ্রায়; জায়গা নিয়েছে মেশিনচালিত প্রস্তুত প্রক্রিয়া।
■ গোয়ালা
এক সময় গোয়ালারা ভোরে ঘুরে ঘুরে সরবরাহ করতেন দুধ, ছানা, দই। এখন সুপারশপ আর প্যাকেটজাত পণ্যের ভিড়ে তারা হারিয়ে গেছেন।
■ সাপুড়ে
লোকসংগীতের ছন্দে ও বাঁশির সুরে সাপ খেলা দেখানো ছিল তাদের পেশা। নগরায়নের জোয়ারে ও জীববৈচিত্র্য সংকটে সাপুড়ে এখন সমাজচ্যুত এক অস্তিত্ব।
■ বাইজি
নবাবি আমলের বিনোদন ও সংস্কৃতির অনিবার্য অংশ ছিলেন বাইজিরা। তাঁদের গানে, নৃত্যে ছিল শিল্পের পরিপূর্ণতা। সমাজ বদলের সঙ্গে তারা হয়ে ওঠেন বিস্মৃত নাম।
■ ভিস্তিওয়ালা
এক সময় ঢাকাবাসীর পানির জোগান দিতেন তারা। চামড়ার মশক কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি পানি পৌঁছে দিতেন। আজ পাইপলাইনের পানির যুগে তারা শুধুই অতীত।
■ নৈচাবন্দ ও টিকিয়াওয়ালা
টিকাটুলির বিখ্যাত টিকিয়া বানানো এক ধরনের শিল্প ছিল। হুঁকার আগুন জ্বালাতে ব্যবহৃত এই টিকিয়া ও তার নির্মাতারা আজ ইতিহাসের পাতায়।
■ কুমোর ও মৃৎশিল্পী
মাটির হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা তৈরি করতেন যাঁরা, তাঁদের স্থান দখল করেছে প্লাস্টিকের পণ্য। তারা হারাচ্ছেন জীবিকা, হারাচ্ছেন সংস্কৃতির স্বীকৃতি।
মসলিনের মৃত্যু, জামদানির উত্তরাধিকার
মসলিন—বিশ্ববিখ্যাত বয়নশিল্প, যার সূক্ষ্মতা ছিল অতুলনীয়। এক গজ কাপড় আংটির ভেতর দিয়ে চালানো যেত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক চক্রান্তে এই শিল্প ধ্বংস করা হয়। বহু তাঁতির আঙুল কেটে দেওয়ার কাহিনী আজ ইতিহাস হলেও তার ক্ষত রয়ে গেছে জাতিগত স্মৃতিতে।
মসলিন হারিয়ে গেলে জন্ম নেয় জামদানি—নকশা ও কারুকাজে অনন্য।
ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত জামদানি কেবল একটি শাড়ি নয়, বরং হাজারো কারিগরের আত্মত্যাগ ও নান্দনিকতার জীবন্ত দলিল।
নতুন পেশার উত্থান: প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে জীবনের রূপরেখা
বিশ্ব এখন দাঁড়িয়ে আছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে।
ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—এসবের ছোঁয়ায় পাল্টে যাচ্ছে পেশার ধারণা।
✅ ডেটা অ্যানালিস্ট ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর
তথ্য বিশ্লেষণ, ইউটিউব, টিকটক, বা ইনফ্লুয়েন্সার হবার দুনিয়া তরুণদের জন্য খোলছে নতুন দিগন্ত।
✅ ফ্রিল্যান্সার ও ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট
একজন তরুণ এখন গ্রামের মাটিতে বসেও কাজ করছেন আমেরিকার ক্লায়েন্টের সঙ্গে—ডলার আসছে মোবাইলে।
✅ ই-কমার্স উদ্যোক্তা
নারীরা এখন ঘরে বসেই হস্তশিল্প, জামদানি বা খাবার পণ্য অনলাইনে বিক্রি করছেন। নিজের পরিচয়ের পাশাপাশি তৈরি করছেন কর্মসংস্থানও।
✅ অ্যাপ ডেভেলপার ও গেম ডিজাইনার
এক সময় যা কেবল বিনোদন ছিল, আজ তা কোটি টাকার বাজার। তরুণেরা নিজেরাই অ্যাপ বানিয়ে হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা।
ই-লার্নিং: পেশা বদলের পথে শিক্ষার নীরব বিপ্লব
আজ আর শিক্ষার জন্য দরকার হয় না শহরে যাওয়ার কিংবা ক্লাসে বসার।
ই-লার্নিং প্রযুক্তি খুলে দিয়েছে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের এক বিপুল দরজা।
* একজন গৃহবধূ রাতে সময় বের করে শিখছেন গ্রাফিক ডিজাইন
* একজন কলেজ শিক্ষার্থী শিখছেন ডিজিটাল মার্কেটিং ইউটিউব ভিডিও দেখে
* একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ভার্চুয়াল টিউটর হয়ে পড়াচ্ছেন বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের
ই-লার্নিং এখন কেবল শেখার মাধ্যম নয়, এটি হয়ে উঠেছে নতুন পেশায় প্রবেশের র্যাম্প।
এই ব্যবস্থায় বয়স, এলাকা বা সামাজিক বাধা আর কোনো অন্তরায় নয়—শুধু প্রয়োজন ইচ্ছা আর ইন্টারনেট।
উপসংহার:
পেশা বদলায় মানেই সমাজ বদলায়
পেশা হারানো মানে কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়।
এটি এক সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং আত্মপরিচয়ের ক্ষয়।
আবার, নতুন পেশার জন্ম মানেই নতুন সম্ভাবনার সূচনা।
যেখানে একজন মানুষ নিজের শর্তে নিজের পরিচয় নির্মাণ করতে পারেন।
আমরা যদি হারিয়ে যাওয়া পেশাগুলোর প্রতি সম্মান রাখি,
আর নতুন পেশার চর্চায় মানবিকতা, সততা ও নান্দনিকতা ধরে রাখি।
তবেই এই পরিবর্তন হবে টেকসই, মর্যাদাপূর্ণ ও গৌরবের।
কারণ সময় পেরোয়, পেশা বদলায়
কিন্তু মানুষের শ্রম, শিল্প আর স্বপ্ন—এই তিনটি চিরকালই অমলিন।
###
Comments