যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যর্থ শুল্ক আলোচনার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে

সরকারের দিক থেকে বেশকিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফায় তিন দিনব্যাপী বাণিজ্য আলোচনা শনিবার শেষ হয়েছে বড় কোন সুখবর ছাড়াই। এক কথায় বলা যায়, মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির উচ্চহারে ধার্য শুল্ক, অর্থাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরোপিত ৩৫ শতাংশ কর কমানোর বিষয়টির কোন সুরাহা হয়নি।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হতে চলেছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যদিও বলছে যে তা কমিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হচ্ছে,ব্যবসায়ীরা তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না। নির্ধারিত সময়ের আগে শুল্ক বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। একমাত্র ভরসা যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে সেটা চান।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্কের গড় হার ১৫ শতাংশ। ট্রাম্পের এই অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হলে বাংলাদেশের জন্য প্রকৃত শুল্কহার হবে ৫০ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে না পারায় এই শুল্কহার বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ৮৭০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে, যা দেশের রফতানি আয়ের ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ২ হাজার ৩৩৭ প্রতিষ্ঠান রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ঘোষণায় দেশের আট শতাধিক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আজ থেকে তিন মাস আগে যুক্তরাষ্ট্র বর্ধিত শুল্কারোপ সংক্রান্ত খসড়া তালিকা ঘোষণা করেছিল। বিভিন্ন দেশের আপত্তির মুখে বর্ধিত শুল্কারোপের কার্যকারিতা তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এই তিন মাস সময়ের মধ্যে কোনো কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের ওপর ধার্যকৃত শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি পণ্যের ওপর ৪৬ শতাংশ শুল্কারোপের কথা জানানো হয়েছিল। ভিয়েতনাম সরকার যুক্তরাষ্ট্রের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের রপ্তানি পণ্যের ওপর আরোপিত বাড়তি শুল্কহার ৪৬ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
ভিয়েতনাম পারলেও আমরা কেন পারলাম না? তিন মাস সময় তো কম ছিল না? এসব প্রশ্নই এখন ব্যবসায়ী মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। ৩৫ শতাংশের কোন সুরাহা তো হয়নি, উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাংলাদেশি বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনায় ৪০ শতাংশ স্থানীয় মূল্য সংযোজনের শর্ত প্রস্তাব করেছেন,যা বাংলাদেশের ব্যবসায়ী সমাজের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায় সরকার শুল্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের পক্ষে কোন ফলপ্রসূ আলোচনা করতে না পারায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বড় ঝুঁকিতে পড়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প বড় অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে একটি নির্ভরযোগ্য পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে শুরু করেছে, এমন সময়ে এই শুল্ক আরোপ করা হলো। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৭.৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। মহামারি থেকে শুরু করে বাজারের পরিবর্তনশীল চাহিদা - সবকিছু সামাল দিয়ে শিল্পটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এখন এই অতি উচ্চ শুল্ক কাঠামোর কারণে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত করা শুরু করেছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় এ উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট বাংলাদেশে পোশাকের কিছু অর্ডার পিছিয়ে দিয়েছে, আর কিছু অর্ডার স্থগিত করেছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স সংবাদও প্রকাশ করেছে। প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিতের আশঙ্কা করছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।
গত বছর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিপুল সংখ্যক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ, দুর্বৃত্তদের হামলা সহ নানা কারণে। এখন আবার সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি এই শিল্প। আমেরিকার বাজারে আগামী গ্রীষ্মকালের পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ধাক্কা খাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকাল হলো নিট গার্মেন্ট রপ্তানির বড় মৌসুম। রপ্তানিকারকদের অনুমান,আগামী মৌসুমে (গ্রীষ্ম ও শরৎ-শীত ২৬/২৭) মোট অর্ডারের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হারাতে পারে বাংলাদেশ। এই অর্ডার হ্রাস শুরু হওয়ায় কারখানাগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে,হুমকির মুখে পড়তে পারে কর্মসংস্থান।
শুল্ক হ্রাস নিয়ে কোন সমঝোতা না হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য একক বড় বাজারে শুধু অর্ডার হারানোর চিন্তা নয়,বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
তিন মাস সময় পেয়েও বাংলাদেশ যে কিছু করতে পারেনি সেটাই এখন স্পষ্ট। হয় বর্তমান সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেনি, নতুবা দক্ষ মানুষদের দরকষাকষিতে পাঠানো হয়নি।
Comments