সেতু আছে, কিন্তু জীবনের সুরক্ষা নেই! মরণফাঁদের মুখোমুখি হাজারো মানুষ

সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা ও আশাশুনি উপজেলার অন্তত ৩০টি গ্রামের মানুষ এক ভয়াবহ দুর্ভোগের মধ্যে দিন পার করছে। কারণ একটাই—মরিচ্চাপ নদীর ওপর নির্মিত সাতটি সেতু একে একে ধসে পড়েছে। কোথাও সেতু নদীতে পড়ে পড়ে আছে, কোথাও আবার বাঁশ দিয়ে তৈরি অস্থায়ী সাঁকো।
যে সেতুগুলো হওয়ার কথা ছিল হাজারো মানুষের যাতায়াতের প্রাণ—তা এখন পরিণত হয়েছে মৃত্যুর ফাঁদে। একে একে ধসে পড়েছে বাকড়া, টিকেট, হিজলডাঙ্গা, চরগোবিন্দপুর, শিমুলবাড়িয়া, ডাড়ার খাল ও এল্লারচর ব্রিজ। এই ব্রিজগুলো নির্মিত হয় ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে। প্রতিটি সেতুই মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিটার দীর্ঘ। অথচ এগুলো নির্মাণের সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি, মানা হয়নি সিএস রেকর্ড।
এই সেতুগুলো নির্মাণের সময় মরিচ্চাপ ছিল মৃতপ্রায় খাল। কিন্তু ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে নদী পুনঃখননের ফলে নদী ফিরে পায় তার আগের রূপ। প্রস্থ বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ থেকে ৭০ মিটার, পানির প্রবাহ বাড়ে বহুগুণে। অথচ সেতুগুলোর দৈর্ঘ্য থেকে কাঠামো পর্যন্ত কিছুই ছিল না সেই পরিবর্তনের উপযোগী। ফলে স্রোতের তোড়ে পাড় ভেঙে পড়েছে, টিকে থাকতে পারেনি দুর্বল সেতুগুলো।
চরগোবিন্দপুরের শুকুর আলী সরদার বলেন, "সেতুগুলো যখন বানানো হয় তখন তো নদী শুকিয়ে ছিল। এখন পানির তোড়ে সেতু আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।"
এল্লারচরের রফিকুল ইসলাম জানান, "এই সেতু দিয়ে অসুস্থ রোগীদের দ্রুত সাতক্ষীরা মেডিকেলে নেওয়া যেত। এখন ঘুরপথে অনেক দূর গিয়ে যেতে হয়। অনেক সময় রোগী পৌঁছায় না সময়মতো।"
ডাড়ার খালের মিজানুর রহমান ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, "আমাদের ঘেরে মাছ উৎপাদন হয়, কিন্তু বাজারে নিতে পারছি না। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পৌঁছাতে পারছে না সময়মতো। আগে যেখানে ৪-১০ কিলোমিটার রাস্তা ছিল, এখন ঘুরে যেতে হচ্ছে ২০ কিলোমিটারেরও বেশি।"
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান সরাসরি দোষ দেখছেন সমন্বয়হীনতার দিকে। তিনি বলেন, "পাউবোর অনুমতি না নিয়েই নদীর উপর এমন ছোট ছোট সেতু বানানো হয়েছে। খননের পর প্রাকৃতিক স্রোতের সামনে এগুলো দাঁড়াতে পারছে না।"
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—একই নদীর ওপর এলজিইডি কর্তৃক নির্মিত একটি ৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু এখনও অক্ষত, যেটি ২০২২ সালে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের অর্থায়নে নির্মিত হয়। এটি প্রমাণ করে—যথাযথ প্রকৌশল পরিকল্পনা থাকলে নদীর প্রবল স্রোতের মধ্যেও সেতু টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শাহিনুল ইসলাম জানিয়েছেন, সেতু ধসের বিষয়টি পরিদর্শন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোয়েব আহমেদ বলেন, ইতোমধ্যে চারটি সেতুর জন্য এলজিইডির মাধ্যমে পুনঃনির্মাণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে।
কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—যেসব সেতু ভেঙে পড়েছে, সেগুলো নির্মাণের অনুমোদন যারা দিয়েছিল, তাদের জবাবদিহি কোথায়? কেন জনজীবনের সঙ্গে এতো বড় ছিনিমিনি খেলাকে অবহেলায় মুছে দেওয়া হবে?
Comments