উত্তাল জ্বালানি তেলের বাজার, হুমকির মুখে বিশ্ব অর্থনীতি

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো হামলা-পাল্টা হামলা চলছে। প্রাণঘাতী এসব হামলার কারণে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর তেলের বাজার উত্তাল হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগতে পারে। সূত্র: আল জাজিরা
ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরাইল, ধ্বংস করেছে কিছু পারমাণবিক স্থাপনা। হামলা চালানো হয়েছে ইরানের গ্যাসক্ষেত্রেও। ইরানি কর্তৃপক্ষের মতে, ইসরায়েলি হামলায় ২২০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৭০ জন নারী ও শিশু রয়েছে।
ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায়। যার একটি ছোট অংশ ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ভেদ করতে সক্ষম হয়, এ ঘটনায় ইসরায়েলের কমপক্ষে ২৪ জন নিহত হয়। তেহরানকে সতর্ক করে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, পরবর্তী হামলা 'আরও নৃশংস' হবে। কিছুই অবশিষ্ট না থাকার আগে ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে একটি চুক্তি করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দু'টি সামরিক বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব যখন একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আর্থিক বাজার এবং বিমান চলাচল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা তেলের দাম পর্যবেক্ষণ করছেন এবং বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের মতো নিরাপদ আশ্রয়স্থলের দিকে ঝুঁকছেন।
সোমবার (১৬ জুন) ভোরে বিশ্বব্যাপী বেঞ্চমার্ক অপরোশোধিত তেল ব্যারেল প্রতি ৭৪ দশমিক ৬০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ইসরায়েলের আকস্মিক আক্রমণের আগের দিন বৃহস্পতিবারের তুলনায় এটি প্রায় ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য মধ্যপ্রাচ্যের ব্যস্ত সমুদ্রপথ দিয়ে যায়, যার মধ্যে অন্যতম হলো হরমুজ প্রণালী। শুধু ইরানই নয়, পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন ও ইরানের জ্বালানি তেল রপ্তানির প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে এ পথের ওপর।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) এক প্রতিবেদন অনুসারে, এ পথ দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের যা প্রায় ২১ শতাংশ।
হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ স্থানের প্রশস্ততা ৩৩ কিলোমিটার (২১ মাইল)। জলপথে জাহাজ চলাচলের পথগুলো আরও সংকীর্ণ, যা তাদের আক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলেছে। ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘাত কয়েক দশকের পুরনো একটি প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে যে, তেহরান কি সমুদ্রপথ বন্ধ করবে, যার ফলে তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইরানের গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণেতা ইসমাইল কোসারির উদ্ধৃতি দিয়ে দেশটির সংবাদ সংস্থা আইআরআইএনএন জানিয়েছে, ইসরায়েলের সাথে সংঘাত তীব্রতর হওয়ার সাথে সাথে তেহরান প্রণালী বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছে।
হরমুজ প্রণালীতে অবরোধ হলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের ওপরে যাবে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় উভয় দেশই উপসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছিল কিন্তু হরমুজ প্রণালী কখনো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল না।
তাছাড়া, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার প্রচেষ্টা সম্ভবত তেহরানের নিজস্ব রপ্তানিকে ব্যাহত করবে, যার ফলে বড় অংকের রাজস্ব হারাবে ইরান। কৌশল ও রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা টিএস লম্বার্ডের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হামজেহ আল গাওদের মতে, প্রণালী বন্ধ করার প্রতিক্রিয়া তেহরানের জন্যই মারাত্মক হবে।
এদিকে ইরানের সরকারি সংবাদ সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত দেশের আকাশসীমা বন্ধ থাকবে।
শুক্রবার ইরাকও তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিমানবন্দরগুলোতে সমস্ত যানবাহন চলাচল স্থগিত করেছে, ইরাকি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে। পূর্ব ইরাক বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ততম বিমান করিডোর অবস্থিত। ইউরোপ এবং উপসাগরের মধ্যে যেকোনো মুহূর্তে কয়েক ডজন ফ্লাইট সেখান দিয়ে যাতায়াত করে- অনেকগুলি এশিয়া থেকে ইউরোপের রুটে।
জর্ডানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই অঞ্চলে সংঘটিত উত্তেজনার ফলে যে কোনো বিপদের আশঙ্কায় তারা সাময়িকভাবে জর্ডানের আকাশসীমা বন্ধ রেখেছে।
Comments