শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যের ছায়াপাত

দেশের কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ অস্থিরতা চলছে। কোথাও এক কলেজের ছাত্ররা আরেক কলেজে হামলা করছে, কোথাও উপাচার্য অপসারণ, কোথাও নাম পরিবর্তনের দাবি, আবার কোথাও আবাসন-সংকটের মতো বিষয় নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন থামে তো আরেকটিতে শুরু হয়।
আমরা দেখেছি কয়েকমাস আগে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ এবং মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। ভয়ানক সেই সংঘর্ষে তিনটি কলেজের, বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী ও মোল্লা কলেজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে সংঘর্ষতো নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে ঢাকা কলেজের সঙ্গে আইডিয়াল কলেজেরও সংঘর্ষ হচ্ছে।
দিনের পর দিন আন্দোলন করেছে ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। সরকারি আশ্বাসে এখন তারা চুপ করে আছে। সরকার বলেছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া পর্যন্ত ইউজিসির তত্ত্বাবধানে সমন্বিত কাঠামোর অধীন চলবে ঢাকার সরকারি সাত কলেজের কার্যক্রম। অন্তর্বর্তী এই ব্যবস্থায় প্রশাসক নিয়োগ না দেওয়ার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে কাজটি আটকে ছিল। এ নিয়ে গত শনিবার আবারও আন্দোলনের হুমকি দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ রকম পরিস্থিতিতে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াসকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা ২৯ দিনের আন্দোলনের পর উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর আগের উপাচার্যকেও এভাবে সরানো হয়েছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট)-এ মাসের পর মাস আন্দোলনের পর উপাচার্যকে সরানো হয়েছে, কিন্তু একাডেমিক কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। আপাতত শান্ত হলেও আন্দোলনে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একটানা প্রতিবাদ, গণজমায়েত, প্রধান উপদেষ্টা বাসভবন অভিমুখে মিছিল, 'কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচী পালন করে, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের মাথায় বোতল ছুড়ে মারা—এসব ঘটনা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছিল।
ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য নিহত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে ক্লাস-পরীক্ষা। উত্তপ্ত হয়ে আছে পুরো ক্যাম্পাস। চলছে প্রতিবাদ, গণজমায়েত ও মিছিল।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম, তৈরি হচ্ছে সেশন জট ও প্রশাসনিক জটিলতাও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার এমন সংকট নিরসনে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনা করে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখাচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কেবল কোনো ঘটনা ঘটলে তার পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
বলতে গেলে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে নিত্য অশান্তির খবর আসছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ গুলোর অস্থিরতা আগেও ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক কালের অশান্তির ধরন এবং তার প্রাবল্যের ছবিটা নতুন। সংঘাত আর শুধু ছোটখাটো সংঘর্ষে সীমাবদ্ধ থাকছে না। গোটা ক্যাম্পাস অচল হচ্ছে, কর্তৃপক্ষকে বার বারই অপরিসীম হেনস্থা এবং অসম্মানের শিকার হতে হচ্ছে। গোটা পরিবেশটাই বিষিয়ে ওঠেছে যেন।
সরকার এ বিষয়ে উদাসীন, এমন অভিযোগও আসছে। ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। গত মার্চে শিক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক সি আর আবরার। তিনি চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি সামলাবার, কিন্তু কিছুতেই রাশ টানা যাচ্ছে না কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতা।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সরকারের পতন ঘটিয়েছে। এই ঘটনা ছাত্রদের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সংগঠিত হলে তারা অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারেন – এমন এক উপলব্ধি একদিকে যেমন রাজনৈতিক সচেতনতা ও শক্তি, অন্যদিকে কখনো কখনো তা হয়ে উঠছে লাগামহীন। ছাত্রদের একটি অংশ আজ কোনো নিয়ম বা প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা মানতে চায় না। তারা দেখছে যে, সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ করলে দাবি আদায় করা যায় যেমন করে সচিবালয়ে ঢুকে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল করে অটো পাসের দাবি আদায় করেছিল তারা।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের অবহেলা, সংস্কারহীনতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দায়িত্বহীন প্রশাসনিক আচরণই এই অস্থিরতার পেছনে প্রধান কারণ। সংকট তীব্র হলে উপাচার্য বদল, সাময়িক প্রতিশ্রুতি - এসব হয়তো আগুন নিভিয়ে রাখে কিছুদিন, কিন্তু স্থায়ী সমাধান দেয় না।
পড়াশোনা, গবেষণা, জ্ঞানচর্চা -এসবই উচ্চ শিক্ষার মূল ভিত্তি। আজ যেন এসব হারাতে বসেছি আমরা। সব জায়গায় সংস্কারের কথা শোনা যায় -প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক সংস্কারের কথাও বহুল উচ্চারিত। কিন্তু শিক্ষা সংস্কারের কথা কোথাও আলোচিত হয়না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করেছে। অথচ শিক্ষা খাত নিয়ে একটি সংস্কার কমিশন হলো না।
শিক্ষাঙ্গনকে কলুষমুক্ত করবেন, নৈরাজ্য মুছে দেবে – এমন প্রতিশ্রুতি সব সরকারই দেয়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখা যায় না। আমাদের উপদেষ্টারাও সতর্কবার্তা, হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিচ্ছেই। শিক্ষাঙ্গে নৈরাজ্যের এই দাপট এক বিষবৃক্ষ। এই প্রবণতার সমূল বিনাশ দরকার। নচেৎ মহীরূহের আকার নেবে এই বিষবৃক্ষ। আশংকা এই যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মটাই নৈরাজ্যের গ্রাসে চলে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক
Comments