একুশ: বাঙালির প্রেরণার বাতিঘর

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান দুটি অংশে বিভক্ত ছিল: পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ব বাংলা) ও পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষাগত অধিকারের প্রতি চরম অবহেলা প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন, "ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা"। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় একই বক্তব্য দিলে ছাত্ররা তীব্র প্রতিবাদ জানায়। বাঙালিরা একে স্বৈরাচারী ও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে এবং প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নিজামুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করেন, "ঊর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"। এর প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীরা ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়, এতে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার ও শফিক শহীদ হন এবং অনেকেই আহত হন।
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। তবে পুলিশ সেদিনই শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে। এতে সারা বাংলায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়।
১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বাংলা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার শহীদ মিনারের পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশায় ভাষ্কর নভেরা আহমেদ সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তবে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির ফলে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। এই শহীদ মিনার একুশের চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর, ইউনেস্কো বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে শহীদদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা ভাষা বহু সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে তার সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছে। একুশ আমাদের অহংকার, আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।
একুশের বইমেলার সূচনা:
চিত্তরঞ্জন সাহা (১৯২৭-২০০৭) ছিলেন সেই অগ্রগামী ব্যক্তি, যিনি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলার সূচনা করেন। তার হাত ধরেই এই বইমেলার পথচলা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক শরণার্থী ভারতের দিকে পাড়ি জমায়। তিনি সাহিত্যিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর পরামর্শে আগরতলা হয়ে কলকাতায় চলে যান। সেখানে আশ্রিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে তিনি বাংলাদেশের লেখকদের বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। এই প্রয়াস থেকেই জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ ও প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা।
বইমেলার প্রথম প্রকাশনা ছিল দুটি গ্রন্থ— "বাংলাদেশ কথা কয়" ও "রক্তাক্ত বাংলা"। শুধু বই প্রকাশেই তিনি থেমে থাকেননি; সাহিত্যিক জহির রায়হান, সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী, ঔপন্যাসিক আহমদ ছফাসহ আরও অনেক বিখ্যাত লেখকের সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় শরণার্থী লেখকদের ৩২টি বই প্রকাশ করেন। এই ৩২টি বইই বইমেলার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং সেখান থেকেই আজকের একুশের বইমেলার যাত্রা শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমিতে বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগে ড. আনিসুজ্জামান, ড. সানজিদা খাতুন, সত্যেন সেন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যুক্ত ছিলেন। সৈয়দ আলী আহসানের পার্ক সার্কাসের বাসায় আলোচনা শেষে বইমেলার কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত একক প্রচেষ্টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একুশের বইমেলা আজ শুধুই একটি বইমেলা নয়, বরং বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার প্রতীক হয়ে উঠেছে, যার ভিত্তিপ্রস্তর গড়েছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা।
লেখিকা: অবসরপ্রাপ্ত কর্পোরেট কর্মী
Comments