কমছে না দ্রব্যমূল্য, নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশ
বাজারে আগুন অনেকদিন ধরেই। ঘরে ঘরে মূল্যস্তরের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ে যখন সরব আলোচনা তখন আবারও খারাপ সংবাদ দিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএস জানাল, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে উঠে গেছে। তথ্যানুসারে, গত মাসে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অক্টোবরে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
বিবিএস-এর পরিসংখ্যান বলছে, নভেম্বরে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত বছরের অর্থাৎ ২০২৩ সালের নভেম্বরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
সারা দেশের ৬৪টি জেলার ১৫৪টি হাটবাজার থেকে নির্ধারিত সময়ে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই ভোক্তা মূল্য সূচক প্রণয়ন করা হয়েছে।
বলা হচ্ছে, নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ, অক্টোবরে যা ছিল ১১ দশমিক ২৬ ভাগ। গত বছরের একই সময়ে অর্থাৎ নভেম্বরে দেশের গ্রামাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। নভেম্বরে গ্রামাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৪১ ও ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। চলতি বছরের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৭৫ ও ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, এবং গত বছরের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮৬ ও ৮ শতাংশ।
সংবাদ বিশ্লেষণ:
খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার ফল
খাদ্যে মূল্যস্ফীতি এখন অসহ। চাল,ডাল,মাংস,সাধারণ আলু,ভোজ্য তেল,সবজিসহ প্রতিটি খাদ্যবস্তুর দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের কাছাকাছি। এবার বিবিএস জানাল, নভেম্বরে দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ১৪ শতাংশ। যেহেতু খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে তাই প্রশ্ন জাগে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমাদের আসলে উদ্বিগ্ন হওয়া বিধেয় কিনা। খরচ বাড়ায় ক্রয় কমিয়েছে বহু মানুষ। একটি অর্থনৈতিক পত্রিকা বাজার অনুসন্ধান করে রিপোর্ট করেছে, তিন মাসের ব্যবধানে মাংসের ভোগ কমেছে প্রায় অর্ধেক। পত্রিকাটি এটাও বলছে যে, বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি থাকায় কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। ভোগপ্রবণতায় মানুষকে বেশ সতর্ক হতে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনায় অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ প্রায় অর্ধেক কমিয়েছে মাংস খাওয়া। হিসেব করলে প্রায় সব পণ্যেই এই চিত্র উঠে আসবে। শংকার জায়গাটা এখানেই যে, খাদ্যের মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে আরও কম পুষ্টি মিলবে মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত তিন মাসে তিনবার নীতি সুদহার কমিয়েও মূল্যস্ফীতির হ্রাস টেনে ধরতে পারেনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় যে, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধটা ঠিকমতো হচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি তিনটি সমস্যা তৈরি করে। প্রথমত,রোজকার কেনাকাটার খরচ বাড়ে। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে গরিব মানুষের পক্ষে খাবারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কঠিনতর হয়। মূল্যস্ফীতি নীরবে গরিব মানুষের টাকা লুট করে। দ্বিতীয়ত,মূল্যস্ফীতির ফলে ব্যবসাও সমস্যায় পড়ে। খাবার কিনতে হলে একটা মাঝারি আর্থিক সামর্থ্যসম্পন্ন পরিবারকে অন্য কোনও খাতে খরচ কমাতে হয়। ততখানি অপরিহার্য নয়,এমন জিনিস কেনাকাটায় কাটছাঁট করতে হয়। যে সংস্থাগুলি এই জাতীয় পণ্য তৈরি করে,তারা বিপাকে পড়ে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারায়। তৃতীয়ত,মূল্যস্ফীতির ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিনতর হয়। এটা শুধু যে গৃহস্থালির ক্ষেত্রে সত্যি,তা নয়,ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সত্যি। যদি খুব বেশি হারে মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকে ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান সবার হিসাবই গুলিয়ে যায়। অতি মূল্যস্ফীতি চলতে থাকলে মানুষের সঞ্চয়ের মূল্য কমিয়ে দেয়,ফলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আগের কথাতেই ফিরে যেতে হয়। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে মানুষ স্বভাবতই কম দামি খাদ্যপণ্যের দিকে ঝুঁকে। খাদ্যাভ্যাসে প্রোটিন, ভিটামিন ও বিবিধ পুষ্টিগুণসম্পন্ন অণুখাদ্যের মাত্রা কমতে থাকলে, তার প্রভাব পড়ে পরিবারের সদস্যদের উপরে। পৌষ্টিক আহারের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর। সুষম আহার না পেলে শিশুদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়,তাদের মানসিক বিকাশ যথাযথ হতে পারে না। কর্মক্ষমতায় ঘাটতি থেকে যায়, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও ঠিক ভাবে গড়ে উঠে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই হার সাম্প্রতিক কালে সর্বোচ্চ। অথচ,ভাত-ডাল বা রুটি-আলুর উপর বাংলাদেশের মানুষের নির্ভরতা সব্জি,মাছ-মাংস বা অন্যান্য খাবারের থেকে বেশি। অতএব খুচরো পণ্যে মূল্যবৃদ্ধি রুখতে হলে খাদ্যশস্যের দামে লাগাম পরাতেই হবে। বিপুল খরচ এবং অনিশ্চিত জীবনের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ যাতে একটু ভাল খেতে পারে তার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে সরকারকেই। এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে বিপন্নতার তীব্রতা অনুভব করছে দরিদ্র মানুষ।
নভেম্বরে শহরাঞ্চলের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৭ শতাংশ; অক্টোবরে যা ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। নভেম্বরে শহরাঞ্চলের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৬৩ ও ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে যা ছিল যথাক্রমে ১২ দশমিক ৫৩ ও ৯ দশমিক ০৬ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের নভেম্বরে যা ছিল যথাক্রমে ১০ দশমিক ৫৮ ও ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ।
গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতির হার দুই অঙ্কের কাছাকাছি। বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের গড় চলন্ত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪২ শতাংশ।