নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্সে এজেন্ট কমিশন বাতিল, ব্যাঙ্কাশিউরেন্স ও বিক্রয় ইকোসিস্টেমে প্রভাব
বাংলাদেশের বীমা খাতে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তন আসন্ন। ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)) নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স সেক্টরে প্রচলিত এজেন্ট কমিশন সম্পূর্ণ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগে সরকার অনুমোদিত কমিশনের হার ছিল সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ, কিন্তু বহু কোম্পানি অনিয়ম করে এর চেয়ে বেশি কমিশন দিত, যা বাজারে স্বচ্ছতা নষ্ট করত ও স্থিতিশীলতার জন্য প্রতিনিয়ত হুমকি তৈরি করত।
আইডিআরএ মনে করে, অতিরিক্ত কমিশন বীমা কোম্পানির সলভেন্সি মার্জিন দুর্বল করে, ভুল ডিসকাউন্টিংকে উৎসাহ দেয় এবং পলিসি বিক্রিকে অসাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়। এছাড়া বাজারে 'কমিশন-ভিত্তিক ডিসকাউন্ট' বীমার প্রকৃত খরচ ও ঝুঁকি মূল্যায়নকে বিকৃত করে।
এই সিদ্ধান্ত নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স-এ ব্যান্কাশিউরেন্স ইকোসিস্টেমে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে।
ব্যান্কাশিউরেন্সের ভবিষ্যৎ কি হবে?
যেহেতু নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট কমিশনের ওপরই নির্ভর করে এসেছে বহু বছর, তাই কমিশন বাতিল হলে প্রশ্ন দাঁড়ায়— ব্যাংক কী প্রণোদনা পাবে নন-লাইফ বীমা বিক্রি করতে?
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইডিআরএ ইতোমধ্যে ব্যাঙ্কাশিউরেন্সের জন্য নীতিমালা জারি করেছে:
- প্রতিটি ব্যাংক সর্বোচ্চ ৩টি লাইফ ও ৩টি নন-লাইফ কোম্পানির সঙ্গে কাজ করতে পারবে।
- ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি, ক্যাপিটাল অ্যাডিকোয়েসি, লাভজনকতা ও এনপিএল স্তর ভালো হতে হবে।
- ব্যাংকের কর্মীদের সার্টিফিকেশন ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।
কিন্তু কমিশন বাতিল হলে ব্যাংকগুলো কীভাবে আয় করবে? প্রচলিত কমিশনই ছিল ব্যাংকের প্রধান আয়ের উৎস। তাই নীতিগত এই পরিবর্তন যদি ব্যাঙ্কাশিউরেন্সে বিকল্প প্রণোদনা না দেয়, তাহলে ব্যাংকগুলো নন-লাইফ ইনস্যুরেন্স বিক্রিতে আগ্রহ হারাতে পারে।
সমাধান: কমিশনের বদলে রাজস্ব-ভিত্তিক ফি মডেল
বিশ্বের উন্নত ব্যাঙ্কাশিউরেন্স বাজারগুলোতে যে পদ্ধতিটি সফল — বাংলাদেশেও সেটি গ্রহণ করা যেতে পারে। সেটি হলো -
রাজস্ব-শেয়ার + পারফরম্যান্স বোনাস মডেল
১. স্বচ্ছ রাজস্ব-শেয়ার (Revenue-Share)
- ব্যাংক নির্দিষ্ট শতাংশ প্রিমিয়াম বা পলিসি প্রতি নির্দিষ্ট অঙ্ক ফি পাবে।
- কোনো গোপন কমিশন থাকবে না।
- ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির আয় পূর্বনির্ধারিত হওয়ায় বাজার স্বচ্ছ হবে।
২. নিয়ন্ত্রিত পারফরম্যান্স বোনাস (Performance Bonus)
- ব্যাংকের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ওপর সীমিত পরিমাণ বোনাস।
- মিস-সেলিংয়ের ঝুঁকি কমে।
- কর্মীদের সঠিক উপায়ে মোটিভেট করা যায়।
বিক্রয় ইকোসিস্টেমে প্রভাব
১. এজেন্ট-নির্ভর বিক্রির যুগ শেষ
বহু কোম্পানি বছরের পর বছর এজেন্ট কমিশনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কমিশন বন্ধ হলে বাজার ধীরে ধীরে কর্পোরেট-চ্যানেল-ভিত্তিক বিক্রিতে যাবে—যেমন ব্যাঙ্কাশিউরেন্স, কর্পোরেট ডিস্ট্রিবিউশন ও ডিজিটাল সেলস।
২. ব্যাঙ্কাশিউরেন্সের গুরুত্ব দ্রুত বাড়বে
ডিজিটাল ব্যাংকিং, কাস্টমার ট্রাস্ট ও ব্যাংকের বিশাল ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের কারণে ব্যাঙ্কাশিউরেন্স হবে নন-লাইফ বীমার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বিক্রয় চ্যানেল।
৩. বাজারে স্বচ্ছতা বাড়বে
কমিশন-ভিত্তিক ডিসকাউন্ট বন্ধ হলে -
- পলিসির প্রকৃত দাম স্পষ্ট হবে
- বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে
- গ্রাহকের আস্থা বাড়বে
৪. কোম্পানিগুলোকে নতুন মার্কেটিং-স্ট্র্যাটেজি নিতে হবে
এজেন্ট কমিশন বাতিলের অর্থ:
- ব্র্যান্ড ভ্যালু
- সার্ভিস কোয়ালিটি
- গ্রাহক স্বার্থরক্ষার সক্ষমতা হবে প্রতিযোগিতার মূল উপাদান।
উপসংহার
আইডিআরএ-এর এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নন-লাইফ বীমা শিল্পে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করবে। এজেন্ট-নির্ভর অসাস্থ্যকর কমিশন-ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ায় বাজার আরও স্বচ্ছ, নিয়মিত ও গ্রাহকবান্ধব হবে।
তবে ব্যাঙ্কাশিউরেন্সকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই একটি সুস্পষ্ট রাজস্ব-শেয়ারভিত্তিক প্রণোদনা কাঠামো তৈরি করা জরুরি।
এমন একটি মডেল ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ও গ্রাহক—তিন পক্ষেরই জন্য হবে সবচেয়ে টেকসই এবং নীতি-সম্মত সমাধান।
লেখক:
ম্যানেজার - ব্রাঞ্চেস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন
গ্রীন ডেল্টা ইন্সুরেন্স পি এল সি
Comments