“ঢেউ কেটে ছুটলো নৌকা, দর্শকদের করতালিতে কাঁপলো নদীর দুই পাড়”

এ যেন নদীর ঢেউ-এর সাথে বৈঠার এক মিলন মেলা। এ মিলন মেলা যেন হাজারো দর্শনার্থীর আনন্দের খোরাক। ইট-বালু আর সিমেন্টের শহুরে জীবনে কিছুটা সময়ের আনন্দে থাকা। আর এমন আনন্দ দিলো হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতা।
শারদীয়া দুর্গাপুজার বিজয়া দমশী উপলক্ষে শুক্রবার (০৩ অক্টোবর) বিকালে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার জলিলপাড় গ্রামে মধুমতি নদীতে ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বর্নির বাঁওড়ে নৌকাবাইচ অনুষ্ঠিত হয়।
জলিরপাড়ের নৌকাবাইচ কেবল একটি খেলা নয়—এটি গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রাণস্পন্দন, যা মনে করিয়ে দেয়—বাংলার আসল শক্তি একতায়, মিলনে আর উৎসবের আনন্দে। মুকসুদপুর উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ নৌকাবাইচে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ২০টি সরেঙ্গা, ছিপ, কোষা, বাছারী, জয়নাগরি, টালী ও ছান্দী নৌকা অংশ নেয়। একের পর এক কুচ চলে নদীর বুক চিরে। একদিকে রোদের ঝিলিক, অন্যদিকে মাঝিদের ঘামে ভেজা শরীর—সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম আবহ। নৌকা যখন ঢেউ কেটে সামনে ছুটে চলছিল, তখন নদীর দুই পাড় কাঁপছিল দর্শকদের করতালিতে। প্রতিটি বৈঠার আঘাত শুধু নৌকার গতি নয়, গ্রামের মানুষের আনন্দকেও বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
এ নৌকাবাইচ দেখতে সকাল থেকেই নদীর দুই পাড়ে হয় জমজমাট পরিবেশ। ভীড় করে নানা বয়েসের দর্শনার্থী। কারও হাতে লাল-নীল পতাকা, কারও হাতে বাঁশি। শিশুদের কোলাহলে মুখর চারপাশ। দুপুর গড়াতেই ঢাক-ঢোলের তালে নদীর ঘাটে ভিড় জমতে থাকে। প্রতিযোগিতার শুরুতে মাঝিরা বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে যখন "হু-হু" স্লোগান তোলে, তখন নদীর পাড়ে দাঁড়ানো হাজারো মানুষের উচ্ছ্বাসে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। নদীর জলে ভেসে ছিল সেই প্রতিযোগিতার উচ্ছ্বাস, মানুষের হাসি আর এক দিনের উৎসবের প্রাণচাঞ্চল্য।
এ নৌকাবাইচ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। এসময় পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো: হাসানুর রহমান, মুকসুদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোস্তফা কামাল ও জলিরপাড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিভা মন্ডল উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার পলাশ কুমার দেবনাথ।
প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছিল গ্রামের মানুষজন, এক টুকরো আনন্দ আর মিলনের উৎসব।
অপরদিকে, একই দিন বিকালে টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বর্নির বাঁওড়ে জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় গ্রামীণ ঐতিহ্যের চিরচেনা উৎসব নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। টুঙ্গিপাড়া উপজেলা বিএনপির এমন আয়োজনে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
এ নৌকাবাইচে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বাগেরহাট, পিরোজপুর জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ১৫টি সরেঙ্গা, ছিপ, কোষা, বাছারী, জয়নাগরি, টালী ও ছান্দী নৌকা অংশ নেয়। চলে একের পর এক কুচ। এ নৌকাবাইচ দেখতে সকাল থেকেই ভীড় করে নানা বয়েসের দর্শনার্থী।
এ নৌকাবাইচে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন তিনি।
এসময় গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবুল বাশার খায়ের, জেলা বিএনপির সদস্য এ্যাভোকেট তৌফিকুল ইসলাম তৌফিক, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এস এম জিলানী বলেন, 'আজ আমরা মুক্ত বাতাসে কথা বলতে পারছি, ঘুরতে পারছি, নৌকা বাইচেও অংশ নিতে পারছি। আপনাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলাম, আপনারাও আমার পাশে থাকবেন।'
তিনি আরো বলেন, নৌকাবাইচ আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। দেশের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে এটি আমাদের সকলকে ধরে রাখতে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে দেশের সকল ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো টিকিয়ে রাখা হবে।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান করেন, এখনো বাংলাদেশের গ্রামীন ঐতিহ্য ধরে রেখেছে নৌকাবাইচ প্রতিযোগীতা। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়। এ সংস্কৃতিটি টিকিয়ে রাখতে আগামীতেও এ নৌকাবাইচের আয়োজন করা হবে।
Comments